এই লেখাটি ১৯৯৫ সনের ২৮শে জুলাই প্রকাশিত হয়েছিল সোসালিস্ট এপীল পত্রিকায়, ফ্রেদরিখ এঙ্গেলসের মৃত্যুর শতবার্ষিকী উপলক্ষ্যে। প্রবন্ধটি লিখেছিলেন ইন্টারন্যাশনাল মার্ক্সিস্ট টেন্ডেন্সির ব্রিটেন শাখা’র দুই কমরেড ম্যারি হ্যানসন এবং রব সোয়েল। বর্তমানে প্রবন্ধটি ভাষান্তর করেছেন মাশিয়াত জাহিন।
বর্তমান সময়ের পরিবার নিয়ে অনেককিছুই লেখা এবং বলা হয়েছে। দৈনন্দিন টানাপোড়েনে ঊর্ধ্ব- গতিতে বিয়ের ভাঙন ঘটছে। অর্থনৈতিকভাবে উন্নত দেশগুলোতে বিবাহ বিচ্ছেদ রেকর্ডমাত্রায় পৌছিয়েছে। ইদানীংকালে টোরি পার্টির লিডাররা টনি ব্লেয়ারের মতবাদের প্রতিধ্বনি তুলে একক অভিভাবক ভিত্তিক পরিবারের প্রতি বিদ্বেষপূর্ণ বক্তব্য দিয়ে, একক পরিবারকে পুঁজিবাদের নৈতিক ভিত্তি হিসেবে প্রশংসা করে। তো এখন আসা যাক, কিভাবে এই পরিবারের উদ্ভব হলো ও এর ভবিষ্যৎ কী?
ঊণবিংশ শতাব্দীতে আমেরিকান নৃতত্ত্ববিদ লুইস হেনরি মরগানের বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের পূর্বে পরিবারকে কখনো একটি শাশ্বত প্রতিষ্ঠানের বদলে কোনো ঐতিহাসিক সত্ত্বা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়নি। এর আগ পর্যন্ত পরিবারের উদ্ভব সম্পর্কে তাওরাত কিতাবের দৃষ্টিভঙ্গির আধিপত্যই বিরাজমান ছিল। মরগানের গবেষণা নৃতত্ত্বের জগতে এবং পরিবার, রাষ্ট্র ও ব্যক্তিগত সম্পত্তি বিকাশের ঐতিহাসিক বোঝাপড়ার ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক ভূমিকা পালন করেছিল। মরগানের ধারণাসমূহ এতই তাৎপর্যপূর্ণ ছিল যে, মার্ক্স ও এঙ্গেলস ইতিহাস নিয়ে তাদের নিজস্ব ধারণা প্রতিপাদন করার জন্য এটি সোৎসাহে গ্রহণ করেছিলেন। এঙ্গেলস বলেন, "ইতিহাসের যে বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গি মার্ক্স প্রায় চল্লিশ বছর আগে আবিষ্কার করেছিলেন, তা নব্য আমেরিকাতে নিজের মত করে আবিষ্কার করেছিলেন মর্গান।”
ইতিহাসের বস্তুবাদী ধারণা অনুযায়ী, মানব ইতিহাসের মূল চালিকা হলো জীবনীশক্তির উৎপাদন ও পুনঃউৎপাদন। সুতরাং মানুষের অন্যান্য সকল কাজের পূর্বেই, তার সর্বপ্রথম ও প্রধান প্রয়োজন হলো জীবন ধারণের প্রণালীসমূহ উৎপাদন করা। অর্থাৎ বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় উৎপাদন তার জন্য সবচেয়ে জরুরি। মানুষ কেমন সমাজে বাস করে তা নির্ধারিত হয় উৎপাদন ব্যবস্থা কোন পর্যায়ে রয়েছে তার দ্বারা, যা আবার প্রতিফলিত হয় তাদের সামাজিক সম্পর্কে। উৎপাদন পদ্ধতি যত আদিম, যেমন ‘আদিম সমাজতন্ত্র’,সমাজের বিন্যাসে যৌন সম্পর্কের ভূমিকা তত প্রবল। বাস্তবে সমাজের ভিত্তি সম্পূর্ণরূপে নির্ধারিত হয় কিভাবে উৎপাদন প্রণালি কাজ করে তার দ্বারা।
আদি উদ্ভব
মরগানের গবেষণা, যা আদিমতম সময় থেকে শুরু করে সভ্যতার সূচনা পর্যন্ত মানব সভ্যতার বিস্তৃত ইতিহাস গভীরভাবে খনন করেছিল এবং এঙ্গেলসের ‘অরিজিনস অফ দ্যা ফ্যামিলি’ প্রকাশের পর থেকে, এই সম্পর্কিত বিজ্ঞান তথা নৃতত্ত্ব, জীববিজ্ঞান ও জীবাশ্মবিজ্ঞানে প্রচুর উন্নতি ঘটেছে। যদিও এসব উন্নতি আমাদের প্রাগৈতিহাসিক যুগের বোঝাপড়ার ক্ষেত্রে নতুন অন্তর্দৃষ্টি নিয়ে আসে, আবার একইসাথে আধুনিক শ্রেণী সমাজের বিভিন্ন কুসংস্কার থেকেও এরা সবসময় বের হতে পারে না। কিছু পর্যবেক্ষক, যেমন প্রাণিবিজ্ঞানী ডেসমন্ড মরিস, আদি মানব সভ্যতাকে বুদ্ধিহীন সহিংসতা, আগ্রাসন ও বর্বরতা এবং শ্রেণি আধিপত্য দ্বারা ব্যাখ্যা করেন- যাতে মানবচরিত্রের দুর্বলতা পরিলক্ষিত হয়। বিগত লক্ষ বছর ধরে মানব চেতনার বিপুল বিকাশের পরও, এই সকল লেখকদের কাছে মানুষ ও শিম্পাঞ্জির মধ্যে কোন গুণগত পার্থক্যই নেই
মরগানের গবেষণাকে খারিজ করার মাধ্যমে এঙ্গেলসের কাজকে খারিজ করার ইচ্ছাকৃত প্রচেষ্টা চালানো হয় প্রায়শই। কেননা মরগানের কাজের উপরই এঙ্গেলসের কাজের ভিত্তি দাঁড়িয়ে ছিল। ওপেন ইউনিভার্সিটি বুক দ্বারা প্রকাশিত ‘আন্ডারস্ট্যান্ডিং দ্যা ফ্যামিলি’(১৯৯৫) (বইয়ের নতুন সংস্করণ) অনুসারে, “এঙ্গেলসের কাজকে এখন পথপ্রদর্শক হিসেবে বিবেচনা করা হয়- বিশেষ করে এখানে এই সমস্যাটিকে তুলে ধরা হয়েছে যে, একক পরিবারের মাধ্যমে কিভাবে পুরুষেরা নারীর যৌনতাকে নিয়ন্ত্রণ করে। কিন্তু এই বইটি কিছু কিছু ক্ষেত্রে বেশ ত্রুটিপূর্ণও বটে।” (পৃষ্ঠা ২) কিন্তু এংগেলসের বক্তব্যের মূল জোর ‘পুরুষ কর্তৃক নারীকে নিয়ন্ত্রণের’ বিষয়টিতে ছিল না, বরং পরিবার, রাষ্ট্র ও ব্যক্তিগত সম্পদকে মানুষের বিকাশের ঐতিহাসিক পর্যায় হিসেবে বোঝাপড়ার মধ্যে ছিল। ক্যারেন স্যাকস ব্যাখ্যা করেন, “যদিও তিনি নিদির্ষ্ট কিছু এথনোগ্রাফিক ভুল করেছেন, তবে আমি মনে করি তার মূল ধারণাগুলো সঠিক এবং তার সময়কাল থেকে প্রাপ্ত তথ্যগুলো ব্যাখ্যা করার শ্রেষ্ঠ পদ্ধতিই এখানে অনুসরণ করা হয়েছে - মূলত ওইসকল নৃতাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিক তথ্য যা দেখায় নারীদের সামাজিক অবস্থান সবখানে অথবা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সবসময় পুরুষের অধীনস্থ ছিল না।” (Karen Sacks, Towards an Anthropology of Women, p. 211.)
এঙ্গেলস তার ১৮৯১ সালের ‘অরিজিনস অফ দ্যা ফ্যামিলি’ এর ভূমিকায় স্বীকার করেন যে, নতুন প্রমাণ নিদর্শন মোতাবেক “মরগানের হাইপোথিসিসে কিছু নির্দিষ্ট যুক্তি নড়বড়ে হয়ে গেছে।”
সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও, মরগানের কাজ মানব বিকাশের আদিমতম সময়কে বিবর্তনের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে আলোকপাত করার চেষ্টা করে। একটি বস্তুবাদী পদ্ধতিতে তিনি সমাজকে তিনটি পর্যায়ে বিভক্ত করেনঃ অরণ্য যুগ, অশিষ্ট যুগ ও সভ্যতা, প্রাথমিকভাবে প্রথম দুই পর্যায় নিয়ে উনি কাজ করেন। প্রত্যেকটি পর্যায় একটা নির্দিষ্ট ধরণের অর্থনৈতিক কার্যক্রম দ্বারা বিশেষায়িত ছিল। অরণ্য যুগ, যা মানব ইতিহাসের প্রায় ৯৯ ভাগ জুড়ে ছিল- তা গড়ে উঠেছিল খাদ্য-সংগ্রহ, সঞ্চয় ও শিকারের উপর ভিত্তি করে। অশিষ্ট যুগের ভিত্তি ছিল কৃষিকাজ ও পশু পালন। সভ্যতা, যার ভিত্তি হলো ব্যক্তি মালিকানাধীন সম্পদ এবং তা একইসাথে পণ্যদ্রব্য উৎপাদনের সূচনা করে।
অরণ্য ও অশিষ্ট যুগের দীর্ঘ সময়কাল ধরে ‘আদিম সাম্যবাদ’ বজায় ছিল, যার মূল ভিত্তি ছিল পারষ্পরিক সহযোগিতা আর আদিম উৎপাদন মাধ্যমগুলোর উপর মানুষের সামষ্টিক মালিকানা।
শিকারি সমাজ
“একদম প্রথম দিককার মানব সমাজ গঠিত ছিল শিকারি ও খাদ্য সংগ্রহকারীর দল নিয়ে -যেখানে শ্রেণি, রাষ্ট্র, পরিবার, ব্যক্তিগত সম্পত্তি, বাজারসহ শ্রেণীসমাজের কোন বৈশিষ্ট্যই ছিল না। এই দল বা গোষ্ঠীগুলো রক্তের সম্পর্ক দ্বারা ‘গোত্র’ বা ‘ক্ল্যান’ হিসেবে সংগঠিত হয়েছিল, আধুনিক নৃবিজ্ঞানীরা যাকে ‘বংশধারা’ বলে থাকেন। এঙ্গেলসের মতে “আদিম সাম্যবাদী’’ সমাজে সবকিছু সুষ্ঠুভাবে চলতো; কোন সৈন্য বা পুলিশ ছাড়া, কোন উচ্চপদস্থ, রাজা, গভর্নর, মালিক বা বিচারক ছাড়া; কোন বন্দী ছাড়া; কোন আদালত ছাড়া। যেকোনো বিবাদ মিটমাট হতো সংশ্লিষ্ট সকল ব্যক্তিকে নিয়ে- পুরো গোত্র অথবা ব্যক্তিদের নিজের মধ্যে...সেখানে কোন গরীব বা অভাবী থাকতো না- আদিম সাম্যবাদী পরিবার ও গোত্রব্যবস্থা বৃদ্ধ, অসুস্থ ও যুদ্ধে আহতদের প্রতি তাদের দায়িত্ব নিয়ে অবগত ছিল। সবাই ছিল মুক্ত ও স্বাধীন- এমনকি নারীরাও।”(Engels, p. 159.)
টিকে থাকার জন্য, সামাজিক সহযোগিতাই আদিম সমাজের বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করতো, যা সরাসরি সরঞ্জাম উৎপাদন ও সম্মিলিতভাবে শিকার এবং খাদ্য সংগ্রহের কাজের সাথে জড়িত ছিল । তাদের জীবনযাপনের ধরণ হচ্ছে ভবঘুরে; আর এই জীবনযাপনের ভিত্তি হচ্ছে তাদের শ্রম দ্বারা উৎপাদিত দ্রব্যের উপর সকলের সামষ্টিক মালিকানা। আদিম সমাজের সহজাত সাম্যের সত্যতা কালাহারির !কুং সানের মতো বর্তমানে টিকে থাকা শিকারি-খাদ্য সংগ্রহকারী সমাজগুলো থেকেই পাওয়া যায়।
শ্রেণি বিভক্ত সমাজের থেকে সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী !কুং দের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো তাদের সমতাবাদ, বিনয় ও সহযোগিতা। রিচার্ড বরশে লী, তাঁর বই ‘দ্যা !কুং সান’-এ একজন সফল শিকারির আচরণ ব্যাখ্যা করেন, “ধরা যাক একটা লোক শিকার করছে। সে কখনোই বাসায় এসে দাম্ভিকের মত ঘোষণা দিবেনা, আমি জঙ্গলে বড় একটা প্রাণী মেরেছি। সে প্রথমে নীরবে বসবে যতক্ষণ না তাকে আমি বা অন্য কেউ তার আগুনের কাছে বসে জিজ্ঞাসা করি, তুমি আজকে কি মেরেছ? সে শান্তভাবে জবাব দেয়, আরে! আমি তো শিকারে একদম ভালো না।তেমন কিছু না, এমনি ছোট একটা শিকার পেয়েছি। কোন !কুং এর কাছ থেকে এমন জবাব শোনার পর, আমি মনে মনে হাসি কারণ আমি জানি সে বড় একটা কিছু মেরেছে”(রিচার্ড বরশে লী, পৃঃ ২৪৪)।
শ্রমের বিভাজন
বেশিরভাগ শিকারি ও খাদ্য সংগ্রহকারী সমাজে নারী ও পুরুষের মধ্যে লিঙ্গের ভিত্তিতে শ্রমবিভাজন হয়ে থাকে, যেখানে পুরুষেরা সাধারণত শিকার করে ও নারীরা শস্য ও গাছগাছালি সংগ্রহ করে। এই বিভাজনের ক্ষেত্রে সম্মান বা শ্রেষ্ঠত্বের কোন সম্পর্ক নেই, এটি হয়ে থাকে বাচ্চা পালনে নারীর ভূমিকা ও দলের উর্বরতা রক্ষা করার জন্য। রিচার্ড লিকি ও রজার লুইন লিখেছেন “খাদ্য সংগ্রহ অভিযানে শিশুদের বহন করা বড় একটা বোঝা। (!কুং মহিলারা কাঁধে দুগ্ধপোষ্য শিশুদের নিয়ে বছরে ১৫০০ মাইলের চেয়ে বেশি হাঁটে) কিন্তু তারা এই কাজে একই রকমের সক্ষমতা রাখেন । যদিও গাছগাছালির খাদ্য সংগ্রহের কাজেও সম্ভাব্য আক্রমনের ঝুঁকি থাকে, শিকারকাজে এই ঝুঁকি আরো বেশি। একটি হিংস্র প্রাণীর ক্ষুধার্ত দাঁতের কাছে নিজ বাচ্চাকে হারানো একজন নারীর মাতৃ জীবনের জন্য বড় আঘাত। বাচ্চাকে ঝুঁকির মুখে ফেলা তার ও তার সঙ্গী কারো জন্যই জৈবিকভাবে বুদ্ধিমানের কাজ নয়। এছাড়াও অন্যান্য কারণেও, সেখানে নারীরা খুব কমই শিকারের কাজ করে থাকে।”
এঙ্গেলস এই আদিম সমাজগুলোতে নারী ও পুরুষের সমতার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। মরগানের গবেষণার উপর ভিত্তি করে, তিনি গোত্র ও বংশধারার প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দেন; যেখানে আপাতভাবে ‘রক্তের বন্ধনের’ উপর ভিত্তি করে সামাজিক সম্পর্ক গড়ে উঠতো। যেমন, মাতৃসূত্রীয় পরিবার ব্যবস্থায় বংশপরিচয় নির্ণয় করা হয় নারীর বংশধারা অনুসারে; একজন মানুষের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বন্ধন হলো তাদের মা ও মায়ের ভাইয়ের সঙ্গে, একইরকম ভাবে একজন পুরুষের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব হলো তার বোনের বাচ্চাদের প্রতি। আবার মাতৃতান্ত্রিক সমাজে, একজন লোক তার স্ত্রী, স্ত্রীর মা ও বোনের দ্বারা চালিত একটি সংসারে প্রবেশ করেন। প্রত্যেক সংসার একটি ভিন্ন গোত্র বা বংশধারার প্রতিনিধিত্ব করে যার নির্দিষ্ট কিছু বাধ্যবাধ্যকতা ও দায়িত্ব থাকে।
মরগান পরিবারের প্রথম ধাপকে ‘সগোত্র’ পরিবার হিসেবে চিহ্নিত করেন যেখানে কোন বংশধারার সকল নারী ও পুরুষ পরস্পরের স্বামী-স্ত্রী। আপাতদৃষ্টিতে সগোত্র বিবাহব্যবস্থা ‘পুনালুয়ান’ পরিবারে উদ্ভবের সাথে সাথে বিলুপ্ত হয়ে যায়, যেখানে পিতামাতা ও সন্তানদের সাথে যৌন সম্পর্ক থেকে বিরত থাকার বিধান চালু হয়। এক্ষেত্রে দলগত বিবাহপ্রথা চালু হয়, যা আবার পরে জুটিবদ্ধ পরিবারের আবির্ভাবে বিলুপ্ত হয়ে যায়। এই ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করেছে একটি নতুন আবিষ্কার যেখানে বলা হয়েছে শিকারী ও খাদ্য সংগ্রহকারী সমাজগুলো বংশধারা বা ক্ল্যান নিয়ে এত কঠোর ছিল না।
তবে এঙ্গেলস এই বিকাশকে সামাজিক সংগঠনের সবচেয়ে প্রাথমিক রূপ হিসেবে দেখেন। যৌন সম্পর্কের (আদিম অবাধ যৌনাচার) একটা দিক ছিল যেখানে সন্তান কেবল তার মাকে চিহ্নিত করতে পারবে। শুধুমাত্র একটা নির্দিষ্ট সময়ের পর, সামাজিক বিকাশের সাথে সাথে পরিবার পিতৃকুলভিত্তিক বা পুরুষের বংশ দ্বারা চিহ্নিত হয়া শুরু হয়। এই ব্যাপারটি শুরু হয় বিশেষত ব্যক্তিগত সম্পত্তির উত্থানের সাথে সাথে। গর্ডন চাইল্ডের মতে, “একেবারে ফসলভিত্তিক সমাজের ক্ষেত্রে, নারীদের সামষ্টিক অর্থনীতিতে অবদানের কারণে, আত্নীয়তা সাধারণভাবে নারী পরিচয়ের ধারায় হয় এবং মাতৃ অধিকারের ব্যবস্থা বজায় থাকে। গবাদি পশুর চল শুরু হবার সাথে সাথে, সমাজের ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রভাব পুরুষের কাছে চলে যায় এবং জ্ঞাতিত্ব হয় পিতৃকুল ভিত্তিক।”(Gordon Childe, What Happened in History, p. 73.)
বিশেষত কৃষির ক্ষেত্রে প্রযুক্তিগত উন্নয়ন, ১০০০০ বছর আগে সামাজিক ও যৌন সম্পর্কে বিপ্লব সাধিত করে। চাইল্ড এটাকে বলেন ‘নিওলিথিক বিল্পব’ যা অরণ্য পর্ব থেকে অশিষ্ট পর্বে বিকাশের পর্যায়কে চিহ্নিত করে। কৃষির উন্নয়ন ও পশুর পোষ মানানোর নতুন পদ্ধতি ও নতুন নতুন যন্ত্র (যেমনঃ নিড়ানি, আড়ত, জাঁতাকল, মৃৎশিল্প) উদ্ভাবনের সূচনা হয় । এইসকল আবিষ্কার, নৃতাত্ত্বিকভাবে, নারীদের কাজ হিসেবে প্রমাণিত হয়। মৃৎশিল্পের রসায়ন, সুতা চরকার কলাকৌশল, তাঁতের কলাকৌশল , শণ ও তুলার কার্যপ্রণালী আবিষ্কারের কৃতিত্বও নারীদের।” (চাইল্ড, পৃষ্ঠা ৬৬) লাঙ্গলের ব্যবহার নারীদেরকে সবচেয়ে কঠোর দাসত্ব থেকে মুক্তি দেয়, কিন্তু খাদ্যশস্য থেকে তাদের একাধিপত্য সরিয়ে নেয়, এর সঙ্গে সঙ্গে সম্পর্কিত সামাজিক মর্যাদার অবস্থানটাও সরিয়ে দেয়। বারবারিয়ানদের মধ্যে, নারীরা সাধারণত ক্ষেত নিড়ানি দেয়, কিন্তু পুরুষেরা জমি চাষ করে” (চাইল্ড, পৃষ্ঠা ৮৯)
নতুন আবিষ্কার ও সম্পদের প্রচলন গোত্রগুলোর মধ্যকার বন্ধনকে দুর্বল করা শুরু করে। যদিও সম্পদ গোত্রের মধ্যেই থেকে যায়, তবে “পরিবারের ক্ষেত্রে এটি পুরুষকে নারীর চেয়ে ক্ষমতাবান আসনে স্থান করে দিল, অন্যদিকে এই ক্ষমতার জোরে পুরুষ প্রচলিত গোত্রবদ্ধ সমাজের উত্তরাধিকার ব্যবস্থাকে প্রতিস্থাপিত করে, কেবলমাত্র নিজের সন্তানকে উত্তারধিকার হিসেবে প্রতিষ্ঠার জন্য উদ্যত হয়েছিল। কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত মাতৃসূত্র অধিকার প্রধান হিসেবে গণ্য হচ্ছিল, ততক্ষণ পর্যন্ত এই প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করা যাচ্ছিল না। যার ফলে মাতৃসূত্রের উৎপাটন জরুরী হয়ে পড়েছিল এবং শেষ পর্যন্ত উৎপাটিত হয়েছিল...” (এঙ্গেলস, পৃষ্ঠা ৯০)
সভ্যতা
অবশেষে “আদিম সাম্যবাদী” সমাজ সভ্যতায় রুপ নেয় এবং শ্রেণি বিভক্ত সমাজের বিকাশ ঘটে, তবে এই বিকাশ ছিল এক প্রকার বিষম বিকাশ। ক্ল্যান বা ট্রাইবের প্রয়োজনের তুলনায় উদ্বৃত্ত সম্পদ উৎপাদনে সক্ষমতার ঘটনাটি বৈপ্লবিক বিকাশের সূচনা করে, কিন্তু এটি ব্যক্তিমালিকানাধীন সম্পদের প্রচলন করেছিল ও পুরনো গোত্রব্যবস্থারও বিলোপ ঘটিয়েছিল। ওই সময়কার সমাজগুলোতে প্রচুর পরিমাণে কৃষিকাজ ও ধাতুর ব্যবহার ছিল। চাইল্ড বলেন, “নিওলিথিক অর্থনীতির সবচেয়ে জঘন্য পরস্পরবিরোধি বৈশিষ্ট্য দেখা দেয়; যখন কৃষকরা নিজ গৃহের প্রয়োজনের চেয়ে বেশি শস্য নিংড়াতে প্ররোচিত বা বাধ্য হয় এবং এই উদ্বৃত্ত শস্য নতুন অর্থনৈতিক শ্রেণিকে বেড়ে উঠতে সাহায্য করে যাদের নিজের খাদ্য উৎপাদনের সাথে সরাসরি কোন সম্পর্ক নেই। এই অপরিহার্য উদ্বৃত্ত উৎপাদনের সম্ভাবনা নিওলিথিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সহজাত প্রকৃতির মধ্যেই পড়ে।” এই পরিবর্তনের উপলদ্ধি সামাজিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্কের পরিবর্তন ঘটিয়েছিল, অন্য কথায়, পুরাতন সামাজিক বিন্যাসে ভাঙন ধরিয়েছিল । এই সামাজিক উদ্বৃত্ত, যা প্রাথমিকভাবে কৃষিকাজ থেকে উদ্ভূত, ক্রমান্বয়ে ধর্মযাজক, আমলাদের একটি বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত সামাজিক শ্রেণীর হাতে জমা হয় যারা ক্রমান্বয়ে নিজেদের সমাজের বাকি অংশ থেকে পৃথক করে ফেলে। একটা সময় পরে, ব্যক্তিগত সম্পত্তি পরিবারের প্রধানদের হাতে উত্তরোত্তর পুঞ্জীভূত হতে থাকে। এটি ছিল শাসকশ্রেণী তৈরির পথে একটি সুনিশ্চিত পদক্ষেপ।
পশুপালন, ধাতব শিল্প এবং চাষাবাদের সাথে সামাজিক উদ্বৃত্ত উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পায়। এই সময় থেকেই দাসপ্রথা একটি সামাজিক বাস্তবতা হয়ে দাঁড়ায়। অতীতে যখন জনগণের চাহিদার অতিরিক্ত কোন উদ্বৃত্ত উৎপাদন হতো না, যুদ্ধজয়ের মাধ্যমে অধিকৃত ট্রাইবের সদস্যদের জবাই করা হতো অথবা ক্যানিবালিজমের ঘটনা ঘটতো, তখন কিন্তু দাসত্ব ছিল না। যখন থেকে উদ্বৃত্ত উৎপাদন শুরু হলো দাস সংগ্রহ করা লাভজনক হয়ে উঠলো। চাইল্ড মন্তব্য করেন, “পরাজিতদের বধ করার প্রয়োজন ছিলো না। কেউ স্থানীয় প্রভুর আচারানুষ্ঠানের অভিভাবক হিসেবে বেঁচে যায়, কেউ ভূমিদাস বা চাকর হিসেবে। মানুষকে ষাঁড় ও গাধার মত পালন করা হতো। যুদ্ধজয় শ্রেণি বিভক্ত সমাজ তৈরি করতো, প্রভু ও দাসের মধ্যে বিভক্ত একটা সমাজ। শ্রেণি বিভাজনের ভ্রুণ প্রাচীনতম ঐতিহাসিক শহরগুলোর মধ্যেই অঙ্কুরিত হয়েছিল। (Childe, What Happened in History, p. 96.)
শ্রেণীসমাজের দিকে যে গতিশীল যাত্রা, এর মধ্যে গোত্রের বিলুপ্তি ও নতুন সামাজিক সম্পর্কের উৎপত্তি প্রতিফলিত হয়। সদ্য বিকশিত শাসক শ্রেণি নিজের হাতে বৃহত্তর অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষমতা পুঞ্জীভূত করে। একক ব্যক্তি পুরুষের হাতে সম্পদের পুঞ্জীভূতকরণ ও তার সন্তানের হাতে তা দিয়ে যাওয়ার যে প্রয়োজন অনুভূত হয়, সেখান থেকেই একগামিতার উদ্ভব। এটাই ছিল নারী শোষণের সূচনালগ্ন। এঙ্গেলস তাই বলেছেন, “মাতৃ অধিকারের বিনাশ পৃথিবীর বুকে স্ত্রীলিঙ্গের ঐতিহাসিক পরাজয়”। এই নতুন পুরুষতান্ত্রিক পরিবার, শ্রেণি, রাষ্ট্র, শ্রেণিসমাজের অন্যান্য উপাদানের উৎপত্তির সাথে সাথে হাত হাত ধরেই বিকশিত হয়েছিল।
"এক কথায়, সম্পদকেই সর্বোত্তম প্রশংসাযোগ্য এবং সম্মানিত মূল্যবান বস্তুতে পরিণত করা হলো। অন্যদিকে পুরোনো গোত্রভিত্তিক যেসব প্রতিষ্ঠান, সেগুলো যেহেতু এই লুঠতরাজভিত্তিক সম্পদকে সমর্থন করেনা, সেজন্য তারা দুর্বল ও বিকৃত হয়ে পড়লো। শুধু একটি প্রতিষ্ঠানেরই অভাব অনুভূত হচ্ছিলঃ এমন এক প্রতিষ্ঠান যা এই নব্য আহরিত ব্যক্তি সম্পদের রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করবে পুরোনো গোত্রভিত্তিক সাম্যবাদী রীতিনীতিগুলোর বিরুদ্ধে। এই প্রতিষ্ঠান, পূর্বে যে ব্যক্তিসম্পদকে অভিসম্পাত করা হতো, সেই ব্যক্তি সম্পদকে পূজনীয় করে তুলবে, ব্যক্তি সম্পদকেই মানব সমাজের সর্বোচ্চ সাফল্য বলে ঘোষণা দিবে, পাশাপাশি নতুন নতুন সম্পদ আহরণের পথও বিকাশ ঘটাবে; যার পরিণতিতে, জনগণের সমর্থনে প্রতিনিয়ত বেড়ে চলবে ব্যক্তিসম্পদ। এমন এক প্রতিষ্ঠান, যা নব্য সমাজে জন্মলাভ করা শ্রেণি বিভাজনকে চিরস্থায়ী করবে এবং সম্পদশালী শ্রেণি দ্বারা সম্পদনহীন শ্রেণির শোষণকে নিশ্চিত করে তুলবে। অতএব অবধারিতভাবেই এই প্রতিষ্ঠানের আবির্ভাব ঘটেছিল। এই উদ্ভাবিত প্রতিষ্ঠানের নাম রাষ্ট্র" (এঙ্গেলস)।
সভ্যতার উদ্ভব শ্রেণি বিভক্ত সমাজের নতুন বৈশিষ্ট্যগুলো নিয়ে হাজির হয়; যেমন নারীর অধীনতা ও নতুন সামাজিক শক্তির উদ্ভবঃ মুদ্রা/অর্থকড়ি/টাকা। ব্যক্তিগত সম্পদের বিকাশের সাথে সাথে পণ্য ও ব্যক্তিগত ঋণের আবির্ভাব ঘটে। প্রাচীন গোষ্ঠিগত সমাজ ভেঙে পড়ে এবং নতুন শ্রেণি সমাজ, যেমন গ্রীক শহরের রাষ্ট্রগুলো, গড়ে ওঠে দাসপ্রথার উপর ভিত্তি করে।
দাস প্রথা
দাসপ্রথা, সামন্তবাদ ও পরবর্তীতে পুঁজিবাদের বিকাশ শোষণের রূপ ও শোষিত শ্রম দ্বারা উদ্বৃত্ত মূল্য উৎপাদনের ধরণ পরিবর্তন করে। সমাজে নারীদের ভূমিকাকে গৃহস্থালি ভূমিকায় সীমাবদ্ধ করা হয়েছিল। এরকম অধীনস্ত পরিস্থিতিতে, সামাজিক উৎপাদন থেকে বিচ্ছিন্নতায় পর্যবসিত হয়ে যাওয়ার ফলে, নারীদের ভূমিকা ছিল মূলত প্রজনন। বর্তমান বুর্জোয়া পরিবারেও এটি চলমান। ‘কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো’তে মার্ক্স এবং এঙ্গেলস উল্লেখ করেছিলেনঃ “বুর্জোয়ারা তাদের স্ত্রীদের কেবলমাত্র সন্তান উৎপাদনের মাধ্যম হিসেবে মনে করে... যৌনকর্মীদের তো বটেই, পাশাপাশি শ্রমজীবীদের স্ত্রী-কণ্যাকে বাগে পেয়েও আমাদের বুর্জোয়ারা সন্তুষ্ট নয়, পরস্পরের স্ত্রীদের কামনাভ্রষ্ট করেও তারা পরম আনন্দ লাভ করে”।
যাহোক, বিশ শতকের দ্বিতীয় ভাগে পুঁজিবাদের দ্বারা অর্থনৈতিক বিস্তারের বিস্ফোরণ নারীদের শ্রমশিল্পে প্রবেশের পথ অবারিতভাবে খুলে দেয়। ব্রিটেনে অর্ধেক শ্রমশক্তি হলো নারী। এটি একটি উল্লেখযোগ্য প্রগতিশীল ঘটনা। এঙ্গেলস যেমন বলেন, “নারীর মুক্তি তখনই সম্ভব হয় যখন নারীরা বৃহৎ সামাজিক হারে উৎপাদনে অংশ নিতে পারে এবং যখন তাদের গৃহস্থালির কাজ সামান্য মনোযোগ দাবি করে।”
কিন্তু পুঁজিবাদে এটি অসম্ভব। কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের বিভাজন ও পরিবারের ভেঙে পড়া পুঁজিবাদের সংকটের ফল। নারী পুরুষের সমতার সম্পর্ক তৈরী হওয়ার বদলে, তৈরী হয়েছে বৈরী বৈষম্যমূলক সম্পর্ক। নারী শ্রমিকদের উপর চাপিয়ে দেয়া হয় মনন ধ্বংসকারী অসাড় কাজ, যার বেশিরভাগ হলো খণ্ডকালীন। ১৮৮৬ পর থেকে এখন ধনী ও গরিবের ব্যবধান যেকোন সময়ের চেয়ে বেশি।
নারীর সত্যিকার মুক্তি ঐসকল নারীবাদিদের সাথে সম্পর্কযুক্ত নয় যারা মূলত মধ্যবিত্ত এবং সমস্যাটিকে নিজ স্বার্থ আদায়ের উপায় হিসেবে দেখে। লক্ষ লক্ষ সাধারণ শ্রমিক শ্রেণির নারীদের দুর্দশা পেটি বুর্জোয়া অধ্যুষিত তথাকথিত নারী আন্দোলনের থেকে লক্ষ মাইল দূরে। তাদের জন্য নারীদের অবস্থান পুরুষের আচরণ ও কুসংস্কারের প্রশ্নে সীমাবদ্ধ; শ্রেণি সমাজের থেকে উদ্ভুত নয়। তারা বিষয়টিকে একটি ‘পুরুষের’ সমস্যা হিসেবে দেখে এবং নারীর অধীনতার সমাধান যৌন আধিপত্যের জায়গা থেকে দেখে, শ্রেণির জায়গা থেকে নয়। তারা পুঁজিবাদের সীমাতেই কাজ করে; পেশাজীবী হিসেবে যেমন উকিল, বিচারক, এমপি, কোম্পানির পরিচালক ইত্যাদিকে মধ্যবিত্ত শ্রেণির নারীদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি করাকে তারা সমাধান হিসেবে দেখে। শ্রমিক শ্রেণির নারীদের অবস্থান অবধারিতভাবেই একটি শ্রেণি প্রশ্ন, যার জন্য দরকার শ্রমিক শ্রেণির নারী ও পুরুষের ঐক্য- যাদের মূল সংগ্রাম হলো পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকে উৎখাত করা, যা শোষণ ও অসমতার ভিত্তিতে দাঁড়িয়ে আছে।
কেবল শ্রেণীসমাজের উচ্ছেদের মাধ্যমেই নারী ও পুরুষের স্বাধীনতা অর্জন সম্ভব। এঙ্গেলস লিখেছিলেন, “একগামিতার জন্ম হয়েছিল যখন উল্লেখযোগ্য পরিমাণে সম্পদ একজন ব্যক্তির হাতে জমা হয়- আর সে ছিল একজন পুরুষ - যার সম্পদের ভার কেবলমাত্র নিজ সন্তানের কাছে দিয়ে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা থেকেই এর জন্ম। এর জন্য একগামিতা প্রয়োজন ছিল নারীর দিক থেকে, পুরুষের দিক থেকে নয়; তাই নারীর একগামিতা কোনভাবেই পুরুষের প্রকাশ্য বা গোপন বহুগামিতাকে বাধাগ্রস্থ করেনি। আসন্ন ভবিষ্যতের সামাজিক বিপ্লব, স্থায়ী উত্তরাধিকারসূত্রের সম্পদের একটি বিশাল অংশকে অর্থাৎ উৎপাদন মাধ্যমকে সামাজিক সম্পদে পরিণত করবে। এটি ক্ষুদ্রতম জনগোষ্ঠির হাতে সম্পদ চলে যাওয়ার উদ্বেগ দূর করবে।” (এঙ্গেলস, অরিজিনস দ্যা অফ ফ্যামিলি, পৃষ্ঠা ১২৩)
ভবিষ্যৎ সমাজতান্ত্রিক পরিবারের বৈশিষ্ট্য কেমন হবে? একগামিতা যেহেতু নির্দিষ্ট অর্থনৈতিক কারণে গড়ে উঠেছিল, কারণগুলো মুছে গেলে কি একগামিতাও হারিয়ে যাবে? ব্যক্তিগত সম্পদের বিলুপ্তির সাথে সাথে, পরিবার একটি অর্থনৈতিক সত্তা থাকবে না আর। সন্তানের দেখভাল সমাজের দায়িত্ব হয়ে যাবে, শুধু সমাজের বস্তুবাদী ভিত্তির পরিবর্তনেই নয় বরং এর সাথে সাথে সম্পূর্ণ সামাজিক ও নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতেও পরিবর্তন আসবে। সমাজতন্ত্রের সমতাবাদী ভিত্তি বাড়বে যখন শ্রেণি সমাজের ‘পুরাতন জঞ্জাল’ বিলুপ্ত হবে। বিপুল প্রাচুর্য ও জনগণের গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণ সমৃদ্ধ একটি অর্থনীতির বিকাশ সকল স্তরে সমাজের দৃষ্টিভঙ্গিকে পরিবর্তন করবে।
গণনির্ধারিত অর্থনীতি
গণনির্ধারিত অর্থনীতিতে, সর্বোচ্চ বৈজ্ঞানিক অত্যাধুনিক পদ্ধতিতে উৎপাদনের মাধ্যমে কর্মঘন্টা কমিয়ে আনা হবে, নারী এবং পুরুষ উভয়েই সমানভাবে নিজেদের ইচ্ছামত শৈল্পিক এবং সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করতে পারবে। যেমনটা এঙ্গেলস বলেছিলেনঃ " একপাক্ষিক একগামীতা যেখানে পুরুষ অধিক সুবিধা ভোগ করে থাকে, তার অবসান ঘটবে"।
শ্রেণী আধিপত্য থেকে সমাজের মুক্তির মধ্যেই নিহিত আছে নারীর মুক্তি। এটার একটা পূর্বশর্ত হলো শ্রমিক শ্রেণীর নারীদের সমাজ পরিবর্তনের লক্ষ্যে শ্রমিক আন্দোলনে অংশগ্রহণ। এটি একটি মূল প্রশ্ন। কেবল সমাজতান্ত্রিক শাসনপ্রণালী যা সাধারণ শ্রমিক শ্রেণির লোকদের জীবন পরিবর্তন করবে, তার প্রচারের মাধ্যমেই বৃহৎ সংখ্যায় নারী শ্রমিকদের আন্দোলনের দিকে ধাবমান করা সম্ভব। আর পলিসিগুলো অবশ্যই শিশুর যত্নের সংস্থানের সাথেও সম্পর্কযুক্ত হতে হবে, যাতে গৃহস্থালির অসুবিধাসমূহ দূর করা যায় এবং অংশগ্রহণের সুযোগ বৃদ্ধি করা যায়।
বাস্তবে, আমরা কেবল সমাজতন্ত্রের মধ্যে পরিবারের রূপ নিয়ে কেবল অনুমানই করতে পারি। এঙ্গেলসের ভাষ্যমতে, নতুন সমাজের লোকেরা “আমরা তাদের যা করা উচিত ভাবি, সেটা নিয়ে বিন্দুমাত্রও পাত্তা দিবেনা। তারা তাদের নিজস্ব রীতি, জনমত প্রতিষ্ঠিত করবে যা প্রত্যেকের চর্চার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ; আর এটাই হলো সবকিছুর শেষ কথা।” একমাত্র যা নিশ্চিতভাবে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব তা হলো পারস্পারিক সম্মান দিয়ে গড়া সম্পর্ক যা শ্রেণি সমাজের দুষ্ট প্রভাব হতে মুক্ত। মানুষ হবে মুক্ত, যারা জীবনের সম্পূর্ণ রস আস্বাদ করতে পারবে।