স্পার্টাকাসঃ প্রাচীন প্রলেতেরিয়াতের প্রকৃত অবয়ব

খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতকে স্পার্টাকাস নামক একজন দাস রোমান পরাশক্তির জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তৃতীয় সার্ভাইল যুদ্ধ নামে পরিচিত এই প্রসিদ্ধ দাসবিদ্রোহের নেতা ছিলেন(অথবা সম্ভাব্য আরও কিছু নেতাদের মধ্যে একজন) স্পার্টাকাস(১০৯ খ্রিঃ পূঃ - ৭১ খ্রিঃ পূঃ)। তার নেতৃত্বে একটি ছোট বিদ্রোহী গ্ল্যাডিয়েটর দল পরিণত হয় বিশাল এক বিপ্লবী ফৌজে, যারা সংখ্যায় ছিল প্রায় এক লাখের মত। শেষ পর্যন্ত রোমান সেনাবাহিনীকে পুরো শক্তি দিয়ে লড়তে হয়েছিল উক্ত বিদ্রোহ দমনের জন্য।

একজন মহান বিপ্লবী নেতা হিসেবে তার যোগ্য সুনাম এবং প্রাচীনকালের একজন অসাধারণ সেনাপতি হওয়া সত্ত্বেও ব্যক্তি স্পার্টাকাস সম্পর্কে তেমন কিছুই জানা যায়না। ইতিহাস সবসময় বিজয়ীর কলমেই লিখিত হয় এবং শতকের পর শতক ধরে ইতিহাসে দাসশ্রেণীর কণ্ঠস্বর শুধুমাত্র অত্যাচারী শ্রেণীর লিখিত ইতিহাসের মাধ্যমেই শুনতে পাওয়া যায়। যেটুকু তথ্যাবলী আমাদের হাতে রয়েছে তা মূলত তার গুরুতর শত্রুপক্ষের বর্ণনার মাধ্যমেই আমরা হাতে পাই। যেসব ঐতিহাসিক নথিপত্র টিকে রয়েছে সেগুলো সব রোমান ঐতিহাসিকদেরই লিখিত এবং স্বভাবতই শত্রুতাপূর্ণ ঢংয়েই লিখিত, কখনও কখনও সেগুলো স্ববিরোধীও।

সেইসময়ে আরও কিছু নেতৃবৃন্দ জড়িত ছিল উক্ত দাসবিদ্রোহে যাদের নাম আমরা এখন জানতে পাইঃ ক্রিক্সাস, ক্যাস্টাস, গ্যানিকাস এবং ওনোমাস- এরাও গ্ল্যাডিয়েটর ছিলেন এবং এসেছিলিন গল ও জার্মানিয়া অঞ্চল হতে। কিন্তু এদের সম্পর্কে জানা যায় আরও কম। যেহেতু ইতিহাস সবসময় বিজয়ী দলের হাতেই লিখিত হয়, সুতরাং স্বাভাবিকভাবেই তা শাসকশ্রেণীর স্বার্থ, মনস্তত্ত্ব এবং শ্রেণী পক্ষপাতিত্বকেই প্রতিনিধিত্ব করে। এসব উৎস থেকে স্পার্টাকাস সম্পর্কে জানতে পারার ব্যাপারটি অনেকটা রাশিয়ান বিপ্লবের শত্রুপক্ষ বুর্জোয়াদের রটানো কুৎসা এবং অপপ্রচার থেকে লেনিন ও ট্রটস্কি সম্পর্কে জানার মত।

প্লুটার্খ এর ভাষ্যমতেঃ

এবং একটি গুপ্ত আস্তানা খুঁজে পাওয়ার পর, তারা তিনজন সেনাপতি নির্বাচিত করেছিল, যাদের মধ্যে স্পার্টাকাস ছিল প্রধান, থ্রেসিয়ান অঞ্চলের যাযাবর গোষ্ঠীগুলো থেকে আসা একজন ব্যক্তি, তা সত্ত্বেও তিনি ছিলেন উচ্চমার্গীয় বীরপুরুষ, তবে সেইসাথে একজন বিনয়ী মানুষও যা তার শ্রেণীর মধ্যে বিরল, থ্রেসিয়ান অঞ্চলের যাযাবর না বলে তাকে গ্রেসিয়ান অঞ্চলের ভদ্রলোকই বলা চলতো।

শত্রুপক্ষের একজন ইতিহাসবিদ হয়েও, প্লুটার্খ ব্যক্তিগতভাবে স্পার্টাকাসের চরিত্রকে উজ্জ্বলতা প্রদান করছে উপরের লেখায়, এমন আচরণের একটি ব্যাখ্যা রয়েছে। ব্যাখ্যাটি কঠিন কিছুও নয়। রোমান রিপাবলিক ধ্বসিয়ে দেয়ার মত শক্তি অর্জনকারী সেনাপতিকে কিছুটাতো অসাধারণ হতেই হয়, কারন সে যদি হয় একেবারেই সাধারণ কোনও দাস শ্রেণী থেকে উঠে আসা ব্যক্তি, তাহলে রোমান রিপাবলিকের “অপরাজেয়” লিজিওন বাহিনীর ভাবমূর্তি নিয়ে জনমনে প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক।

অন্যান্য রোমান ইতিহাসবিদেরা আরও কয়েক কাঠি সরেস এই ব্যাপারে, কেউ কেউ দাবী করেছে স্পার্টাকাস অভিজাত বংশ থেকে আসা ব্যক্তি, এই দাবীগুলোও উপরোক্ত একই কারনে। কেউ কেউ তাকে চিত্রিত করেছে অতিমানবীয় শক্তিধর ব্যক্তি হিসেবে। তার পত্নী ছিলেন একজন যাদুকরী ধর্মগুরু, এবং এমন আরও অনেক রঙচঙে ব্যাখ্যা দেখতে পাওয়া যায়। এটা স্পষ্ট যে স্পার্টাকাসকে এমন অসাধারণ অতিমানব হিসেবে হাজির করার ব্যাপারটি মূলত রোমান প্রপাগান্ডা। কারন কিছু কৃষক, বাবুর্চি ও গ্লাডিয়েটর দিয়ে তৈরী সেনাবাহিনীর সামনে রোমানরা এত হুমকিবোধ করেছিল ও যুদ্ধক্ষেত্রে অপদস্ত হয়েছিল যে, এটা স্বীকার করা রোমান শাসকশ্রেণীর জন্য লজ্জ্বাকর এবং অপমানজনক। 

স্পার্টাকাসের আদি বংশীয় ধারা সম্পর্কে তেমন কিছু স্পষ্ট জানা যায়না আর প্রাচীন ইতিহাসের নথিপত্রও এই বিষয়ে একমত নয়, ধারনা করা হয় তিনি তৎকালীন থ্রেস অঞ্চলের(বর্তমান বুলগেরিয়া) বাসিন্দা ছিলেন। অনেকেই মনে করেন জীবনের প্রথমিক পর্যায়ে তিনি সামরিক প্রশিক্ষণ লাভ করেছিলেন রোমান সেনাবাহিনীতে ভাড়াটে সৈনিক হিসেবে কাজ করার বদৌলতে। প্লুটার্খের কাছ থেকে আরও জানা যায় যে, পরবর্তীতে স্পার্টাকাসের সাথে তার পত্নী যিনি উক্ত নৃগোষ্ঠীর একজন ধর্মগুরু ছিলেন, তিনিও দাসে পরিণত হন। স্পার্টাকাস দাসে পরিণত হওয়ার পর প্রথমে তাকে নিলামে বিক্রি করে দেয়া হয় কাপুয়া প্রদেশে গ্লাডিয়েটর হিসেবে। আপ্পিয়ানের মতে, “জন্মসূত্রে তিনি ছিলেন একজন থ্রেসিয়ান, যিনি একসময় রোমান সেনাবাহিনীতে সৈন্য হিসেবে কাজ করেছিলেন, কিন্তু পরবর্তীতে তিনি বন্দী হন এবং গ্লাডিয়েটর হিসেবে তাকে বিক্রি করে দেয়া হয়।” ফ্লোরাসের মতও অনেকটা এরকমই, “রোমান সৈন্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করার পর তিনি একজন যাযাবর ও ডাকাতে পরিণত হন, এবং পরবর্তীতে তার অসাধারণ দৈহিক শক্তির কারনে গ্লাডিয়েটর হিসেবে তাকে নিযুক্ত করা হয়।” 

গ্লাডিয়েটরদের বিদ্রোহ

স্পার্টাকাস বিদ্রোহ এমন সময়ে ঘটেছিল যখন রোমান রিপাবলিকের পরিস্থিতি টালমাটাল এবং এই পরিস্থিতির অবসান ঘটে সিজার শাসনামলের উত্থানের মাধ্যমে। রোমান সীমান্তের পরিধি ক্রমে পূর্ব এবং পশ্চিমে বৃদ্ধি পেয়ে চলছিল; উচ্চাকাঙ্ক্ষী সেনাপতিরা নাম কামানোর জন্য স্পেন ও মেসিডোনিয়া অঞ্চলে যুদ্ধ পরিচালনা করতেন, পরবর্তীতে তারা রোমে ফিরে এসে নিজেদের রাজনৈতিক ক্যারিয়ার গড়তেন। রোম ছিল একটি যুদ্ধভিত্তিক সমাজঃ এমনকি বিনোদনের মাধ্যম হিসেবেও সেখানে সাজানো মঞ্চে গ্লাডিয়েটরদের লড়াই প্রদর্শিত হতো। বিজয়ী গ্লাডিয়েটেরদেরকে আলাদা সম্মান দেয়া হতো এবং সেলিব্রেটির মত দেখা হতো, যদিও সোসাল স্ট্যাটাস অনুযায়ী তাদের অবস্থান ছিলো বন্দী আসামিদের সামান্য উপরে। এটা খুবই স্বাভাবিক, কারন অনেক গ্লাডিয়েটরই বন্দী আসামিদের মধ্য থেকেই উঠে আসতো। বাকিরা আসতো দাসশ্রেণী থেকে। মোটামুটিভাবে হিসাব করলে বলা চলে, এই সময়ে ইতালিতে প্রায় তিনজন ব্যক্তির মধ্যে একজন ব্যক্তি ছিলেন দাস। দাসরা প্রায়শই তুচ্ছ কারনে তাদের মালিকের কাছ থেকে তীব্র শাস্তি পেত, একজন রোমান নাগরিকের শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদন্ড ছিল কদাচিৎ ব্যাপার(এমনকি যদিওবা হতো, তা হতো একেবারেই মানবিক উপায়ে), অন্যদিকে দাসদের প্রায়শই ক্রুশবিদ্ধ করা হতো।

স্পার্টাকাস কাপুয়া প্রদেশের নিকটে অবস্থিত একটি গ্লাডিয়েটর স্কুল(লুডাস) থেকে প্রশিক্ষনপ্রাপ্ত হয়েছিলেন, যে স্কুলের মালিক ছিলেন লেন্টুলাস বাটিয়াটাস। এখানে ৭৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে স্পার্টাকাস প্রথম ৭৪জন গ্লাডিয়েটর নিয়ে বিদ্রোহ শুরু করেন যারা অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে সেখানকার পাহাড়াদারদের পরাজিত করে, এবং পালিয়ে যায়। এর বর্ণনা আমরা প্লুটার্খের রচিত রোমান ইতিহাসের একটি অংশে দেখতে পাই যার নাম দ্য লাইফ অফ ক্রাসাসঃ

"তৎকালীন সময়ে ইতালিকে বিধ্বস্ত করে দেয়া গ্লাডিয়েট বিদ্রোহকে সাধারনত স্পার্টাকাসের যুদ্ধ নামে অভিহিত করা হয়। কাপুয়াতে অবস্থিত লেন্টুলাস বাটিয়াটাসের একাডেমিতে অনেক বিখ্যাত গ্লাডিয়েটররাই প্রশিক্ষণ নিত, এদের মধ্যে বেশিরভাগই ছিল গল এবং থ্রেসিয়ান অঞ্চলের, যাদের মূলত কোনও অপরাধের কারনে নয় বরং তাদের মালিকদের নিষ্ঠুর স্বেচ্ছাচারিতার কারনবশত গ্লাডিয়েটর বানিয়ে পরস্পরের মধ্যে যুদ্ধে লিপ্ত রাখা হতো। এদের মধ্যে প্রায় দুইশোজন গ্লাডিয়েটর মিলে সেখান থেকে পালিয়ে যাওয়ার নকশা করে কিন্তু ধরা পড়ে যাওয়ার ফলে তাদের মালিকেরা সতর্ক হয়ে যায়, এবং এর ফলে মাত্র ৭৮জন গ্লাডিয়েটর সেখান থেকে বের হবার সুযোগ পায়, তারা বাবুর্চির দোকান থেকে চাকু চাপাতি ইত্যাদি নিয়ে বিদ্রোহ শুরু করে শহর থেকে পালাতে সফল হয়, পথিমধ্যে তারা বিভিন্ন মালবাহী গাড়ী লুট করে যেগুলো মূলত গ্লাডিয়েটরদের অস্ত্র পরিবহনের কাজে নিয়োজিত ছিল। অস্ত্রবাহী গাড়ি লুটের মাধ্যমে তারা নিজেদের অস্ত্রে সজ্জিত করে ফেলে দ্রুতই। পরবর্তীতে তারা পালিয়ে একটি সুবিধাজনক স্থানে নিজেদের আস্তানা গড়ে, সেখানেই তারা নিজেদের তিনজন সেনাপতি নির্বাচিত করে, এই সেনাপতিদের মধ্যে থ্রেসিয়ান অঞ্চলের যাযাবর গোষ্ঠী থেকে আগত উচ্চ মানসিক দক্ষতাসম্পন্ন এবং বীরপুরুষ কিন্তু একইসাথে বিনয়ী গুনসম্পন্ন যেটাকে গ্রেসিয়ানদের মূল বৈশিষ্ট্য মনে করা হতো, সেই স্পার্টাকাস ছিলেন প্রধান।"

বাবুর্চি দোকান থেকে চাপাতি সংগ্রহ করে এবং অস্ত্রবাহী গাড়ী লুট করে তারা চলে যায় ভিসুভিয়াস পাহাড়ের জঙ্গলে, যা বর্তমানে নাপোলি অঞ্চল নামে পরিচিত। দাসদের বিদ্রোহ করে পালিয়ে যাওয়ার এই খবরটি দ্রুতই ছড়িয়ে পড়ে অন্যান্য দাসশিবিরে এবং তারাও উদ্বুদ্ধ হয়। ধীরে ধীরে গ্রামাঞ্চলের দাসগোষ্ঠীগুলো থেকে বিদ্রোহীরা যোগ দিতে থাকে স্পার্টাকাসের দলে। দল ভারী হয়ে গেলে তারা উক্ত অঞ্চলের খামারগুলোতে হানা দিতে থাকে নিজেদের খাদ্য যোগানের জন্য। এভাবে বিদ্রোহী দল ছোট ছোট বিজয় অর্জনের মাধ্যমে আরও বড় বিজয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। প্লুটার্খের বর্ণনায়ঃ প্রথমে তারা কাপুয়া থেকে বিদ্রোহ করে বেড়িয়ে এসে নিজেদের আস্তানা গড়ে, তাদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেলে তারা সৈন্যদের মত উপযুক্ত অস্ত্রে সজ্জিত হয় এবং তাদের অতীতে ব্যবহৃত গ্লাডিয়েটরদের অস্ত্রগুলোকে বর্বর এবং অপমানজনক আখ্যা দিয়ে ত্যাগ করে।

শুরুর দিকের এই বিজয় উল্লাসগুলো খুব সহজেই আপনারা কল্পনা করে নিতে পারবেন, তারা এতই উল্লসিত হয়েছিল যে তাদের পুরনো গ্লাডিয়েটরের সাজসজ্জা পোশাক ত্যাগ করে তারা নিজেদেরকে আগাগোড়া একদম সেনাবাহিনীর সাজপোশাক নিয়েছিল। তবে তাদের এই ছোট আচরণটি শুধু সাজসজ্জা বা অস্ত্রের পরিবর্তনই চিহ্নিত করেনা, এর পিছনে আরও একটি বড় বিষয় কাজ করেছিল। এটা শুধুমাত্র সার্ভাইল রাষ্ট্রের বিধিনিয়ম প্রত্যাখ্যান করার প্রতীক নয়, তাদের ক্রমবর্ধমান আত্মবিশ্বাস এবং দাস মানসিকতা থেকে মুক্ত হওয়ার প্রতীকও বটে। আমরা এই একই আচরণ ইতিহাসের প্রতিটি বিদ্রোহ ও বিপ্লবের সময়েই দেখতে পাই, যেখানে শ্রমজীবী শ্রেণী(যারা পারতপক্ষে দাসশ্রেণীরই আধুনিকায়িত রূপ) তাদের চিন্তা ও চেতনার উচ্চতর পর্যায়ে পৌঁছায় এবং একজন মুক্ত মানুষের মত আচরণ শুরু করে।

এই দাসবিদ্রোহ কোনভাবেই একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিলোনা। বিদ্রোহের খবর যখন রোমে পৌঁছালো তখন এটি শাসকশ্রেণীর জন্য কিছুটা চিন্তার কারন হলেও কোনও আকস্মাৎ বিস্ময়কর ঘটনা হিসেবে খুব বেশি উদ্বিগ্নতার জন্ম দেয়নি। এর পূর্বের শতাব্দীতে দুইটি দাসবিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছিলো সিসিলি অঞ্চলে এবং সেগুলো কঠোর হস্তে দমন করা হয়েছিল হাজার হাজার দাস হত্যার মাধ্যমে। এসব কারনেই তৎকালীন রোমান সিনেটররা ভেবেছিলো এই বিদ্রোহও ঠিক একইভাবে দমন করে ফেলা যাবে, যাদের হাতে পুরো বিশ্বের নিয়ন্ত্রণ তাদের আর এসবে ভয় কী!

যার ফলে প্রথমদিকে রোমান কতৃপক্ষ স্পার্টাকাসকে তেমন একটা আমলে নেয়নি। তারা বিষয়টিকে এতটাই তুচ্ছ মনে করেছিল যে বিদ্রোহ দমনের জন্য তারা কোনও লিজিওন বাহিনীও পাঠায়নি, বরং ক্লডিয়াস গ্লেবার নামে একজন ম্যাজিস্ট্রেটের তত্ত্বাবধানে ৩০০০ সৈন্যসামন্ত পাঠিয়েছিল। তারা এটিকে অনেকটা পুলিশি অভিযানের মতই ভেবেছিল যা সহজেই দমনযোগ্য। অস্ত্রসজ্জিত কিছু আনাড়ি দাসদের দমনের জন্য ম্যাজিস্ট্রেটের অধীনে তিন হাজার সৈন্য পাঠানোর পদক্ষেপটিই তাদের কাছে যথেষ্ঠ মনে হয়েছিল। কিন্তু এতদিনে স্পার্টাকাসের শিবির একটি চুম্বকের মত হয়ে উঠেছিল আশেপাশের এলাকার দাসদের জন্য, হাজার হাজার দাস এসে এই শিবিরে যোগদান করছিল। এই সৈন্যরা নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদ থেকে লড়াই করে চলছিল, যেই তাগিদ রোমান সেনাপতিদের ছিলোনা। রোমান সেনাপতিরা বরং এই শত্রু দলটিকে দুর্বল ভেবে অবমূল্যায়ন করেছিল প্রথম থেকেই। 

এটা সবারই ভাল করে জানা যে, বিপ্লবীরা শুধুমাত্র আক্রমনাত্মক পদক্ষেপ এবং দুঃসাহসিকতার মাধ্যমেই বিজয় লাভ করতে পারে। রোমানরা বিদ্রোহ দলটিকে ভিসুভিয়াসের চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে পালানোর পথ বন্ধ করে দেয়। দাসগোষ্ঠী বুঝতে পারলো তাদের পালানোর আর কোনও পথ নেই শুধুমাত্র একটা সংকীর্ণ উপত্যকা রয়েছে যা নিজেরা পাহারা দিচ্ছিল, কিন্তু সেটি খুবই কঠিন পথ কারন পাহাড়ের ঢাল স্বাভাবিকভাবেই পিচ্ছিল। এমন অবস্থায় স্পার্টাকাস একটি চমৎকার ফন্দির ব্যবস্থা করে ফেললেন, তিনি পাহাড়ি গাছপালার লতা দিয়ে দড়ি তৈরী করলেন যেটির সাহায্য তার সৈন্যরা আগ্নেয়গিরির পিছন দিক থেকে নেমে রোমান সৈন্যদেরকে আকস্মাৎ আক্রমন করে। 

প্লুটার্খের ভাষায় ঘটনার বর্ণনা নিম্নরূপঃ

তারা পাহাড়ের উপরে যেসব বন্য গাছপালা ছিল সেগুলোর লতা কেটে মুড়িয়ে শক্ত দড়ির মত বানিয়ে তা দিয়ে লম্বা মই বানালো যা পাহাড় থেকে নামার জন্য যথেষ্ঠ। এভাবে এক এক করে সকল সৈন্য পাহাড় থেকে নেমে গেল রোমান সৈন্যদের পিছন দিক থেকে, শুধুমাত্র একজন উপরে ছিল যে স্পার্টাকাসের সৈন্যদলকে উপর থেকে অস্ত্রের সাপ্লাই দিচ্ছিল। নিচে নেমে এসে অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে তারা পিছন দিক থেকে রোমান সৈন্যশিবিরে আকস্মাৎ আক্রমণ চালায়, ফলস্বরূপ স্পার্টাকাস বাহিনীর বিজয় লাভ করে।

ক্লডিয়াস গ্লেবার স্পার্টাকাসের দাস বাহিনীকে এতটাই তুচ্ছ ভেবেছিলো যে, হয়তো তিনি তার সৈন্যশিবিরের প্রাথমিক সুরক্ষাও নিশ্চিত করার তাগিদ বোধ করেনি। পাহারায়ও কোনও সৈন্যসামন্ত বসায়নি হয়তো একই কারনে। এই অবহেলার ফল রোমানদেরকে খুব উচ্চমূল্যে শোধ করতে হয়েছিল। বেশিরভাগ সৈন্যরাই ঘুমন্ত অবস্থায় নিজেদের বিছানাতেই নিহত হয়েছিল দাসবাহিনীর হাতে, এমনকি ম্যাজিস্ট্রেট ক্লডিয়াস গ্লেবারও। এটি রোমানদের জন্য প্রচন্ড অপমানজনক একটি পরাজয় ছিল। দাসবাহিনীরা এখন আরও বেশি অস্ত্র লাভ করলো পরাজিত সৈন্যশিবির থেকে। তার থেকেও গুরুত্বপূর্ণ, তাদের এমন একটি মনোভাবের তৈরী হল যে, তারা যুদ্ধ করতে পারে এবং জিততেও পারে। এই মনোবলই সবথেকে বড় বিজয় ছিল।

স্পার্টাকাসের উত্তর অভিমুখে যাত্রা

স্পার্টাকাস একজন চমৎকার রণকৌশলী ছিলেন, যা থেকে ধারনা করা যায় তিনি হয়ত রোমান সেনাবাহিনীতে সৈন্য হিসেবে কাজ করেছিলেন। যদি এটা সত্য হয়ে থাকে, তাহলে রোমান সেনাবাহিনীর সকল রণকৌশল আগে থেকেই জানা থাকবে স্পার্টাকাসের, এবং এর সাথে একজন বিপ্লবীর আবশ্যিক দুঃসাহসিকতা তাকে রোমান শাসকগোষ্ঠীর একজন দুর্দান্ত ভয়ংকর শত্রুতে পরিণত করেছিল। তবে তার সেনাবাহিনীর বেশিরভাগ সৈন্যই দাসশ্রেণী থেকে এসেছিল, তারা ছিল যুদ্ধে অদক্ষ এবং অস্ত্রহীন। এই ব্যাপারটির কারনে স্পার্টাকাসের রণকৌশলও কিছুটা বদলে যায়, প্রথমদিকে তারা একেবারেই আত্মরক্ষামূলক কৌশলে কাজ করে যাচ্ছিল, ভিসুভিয়াস পাহাড়ে বনেজঙ্গলে গোপন আস্তানায় অবস্থান করছিল। সময়ের সাথে সাথে তিনি দাসদেরকে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন ভবিষ্যতে রোমান সেনাবাহিনীর মুখোমুখি হবার জন্য।

পরবর্তী যুদ্ধের আগে হাতে সময় খুবই কম এটা স্পার্টাকাস উপলব্ধি করতে পেরেছিল ভালভাবেই, যার কারনে তিনি প্রশিক্ষণের কৌশলও বদলে ফেলেন, তিনি প্রথমে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত গ্লাডিয়েটরদেরকে ছোট ছোট প্রশিক্ষক গ্রুপে ভাগ করেন, যারা ছোট ছোট আনাড়ি দলকে প্রশিক্ষণ দেয়, পরবর্তীতে নব্য প্রশিক্ষিত দলগুলো আবার নতুন আনাড়ি একটি দলকে প্রশিক্ষণ দেয়, এই কৌশল অবলম্বনের মাধ্যমে মাত্র কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই পুরো দাসবাহিনী একেবারে দক্ষ সেনাবাহিনীতে পরিণত হয়। তবে আসল যুদ্ধ করার অভিজ্ঞতা এখনও সবার হয়নি, যেটি তারা পূরণ করেছিলো জনগণের পক্ষে লড়াই করার বীরত্ব এবং নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদ দিয়ে, নিজেদের দাসত্বের বেড়ি ছাড়া তাদের হারানোর আর কিছু নেই এটাই তারা বারবার স্মরণে রাখতো।

রোমান সেনাবাহিনীর সাথে অনেকগুলো খন্ডযুদ্ধ এবং দাঙ্গার মত হয়েছিল যার সবগুলোতেই বিদ্রোহী বাহিনী বিজয় লাভ করে ছিল। পাব্লিয়াস ভেরিনাস নামের একজন ম্যাজিস্ট্রেটকে দুই হাজার সৈন্যসমেত পাঠানো হয়েছিল, যাদের সাথে সরাসরি যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিল বিদ্রোহী বাহিনী এবং বিজয় লাভ করেছিল। এরপর কসিনিয়াসকে পাঠানো হয় “যথেষ্ঠ সৈন্যসামন্ত” সহ, কিন্তু তারাও পরাজিত হয় এবং তিনি কোনওমতে নিজের প্রাণ নিয়ে পালিয়ে যান। পশ্চাতে হঠা এই রোমান বাহিনীকে বিদ্রোহী বাহিনীরা ধাওয়া করে অনেক রোমান সৈন্যকে হত্যা করে এবং পথিমধ্যে তারা রোমান শিবিরও দখল করে নেয়, পরবর্তীতে কসিনিয়াসকেও হত্যা করা হয়।

এরকম প্রত্যেকটি বিজয়ের সাথে সাথে বিদ্রোহী দলের মনোবল বেড়েই চলছিল। আর এরকম বড় পরাজয়ের রিপোর্ট পড়ে নিশ্চই রোমান সিনেট সদস্যদের মুখে নেমে এসেছিল ঘোর অন্ধকার। ধীরে ধীরে তাদের এই সত্য আবিষ্কারের ফলে সবথেকে কঠোর অভিজাত ব্যক্তিটিও উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লো এবং উপলব্ধি করলো তারা এক ভয়ংকর শত্রুর মোকাবেলা করতে চলেছে, যাদের রয়েছে বিশাল সৈন্যবাহিনী, উন্নত শক্তিশালী অস্ত্র। অত্র অঞ্চলের প্রতিটি খামারে প্রতিটি ঘরে অবস্থিত দাসেরা একেকজন হয়ে উঠলো সম্ভাব্য বিদ্রোহী, শাসকশ্রেণী তাদেরকে দেখতে লাগলো শংকিত এবং সন্দেহের চোখে। কসিনিয়াসকে হারিয়ে দেবার এই সাফল্যমণ্ডিত বিজয়ের পরই স্পার্টাকাসের নাম আরও বিখ্যাত হয়। এই বিজয়ের সংকেত খুবই স্পষ্ট ছিলোঃ রোমানরা মোটেও অপরাজেয় নয়।

পালিয়ে আসা দাসশ্রেণীর লোকজন দলে দলে যোগ দিতে লাগলো এবং খুব দ্রুতই একটি ছোট বিদ্রোহী গ্রুপ পরিণত হলো বিশাল সেনাবাহিনীতে। কিছু হিসাব অনুযায়ী শেষ পর্যন্ত সম্ভবত প্রায় এক লাখ চল্লিশ হাজার দাস যোগ দিয়েছিল উক্ত দলে, যারা সবাইই তাদের মালিকশ্রেণীর বছরের পর বছর অত্যাচার, প্রতিকূল পরিবেশে কাজ করার তিক্ত অভিজ্ঞতা, ইত্যাদি থেকে পালিয়ে এসেছিল। প্লুটার্খের বর্ণনায়ঃ “বহু রাখাল এবং পশুপালক দাসেরা এসে দলে যোগ দিতে থাকে, কেউ শক্তিশালী কেউ দুর্বল, তাদের মধ্যে উপযুক্তদের প্রশিক্ষণ দিয়ে ভারী অস্ত্রে সজ্জিত করা হয়, বাকিদের নিয়ে সহযোগী দল বানিয়ে তাদেরকে হালকা অস্ত্রে সজ্জিত করা হয়।” এখানে প্লুটার্খ “বহু” বলতে যে সংখ্যা বুঝাচ্ছে তা মূলত হাজারকে হাজার।

স্পার্টাকাসের ফৌজ ৭৩খ্রিস্টপূর্বাব্দের শীতকালটি ইতালির দক্ষিণ উপকূলে কাটিয়ে দেয় রণসজ্জা, সৈন্যসংখ্যা এবং মনোবল বৃদ্ধির কাজে ব্যস্ত থেকে। বসন্ত শুরু হলে তারা উত্তরের দিকে অভিযান শুরু করে। এই অভিযানের পরিকল্পনা ছিল খুবই দুঃসাহসিক, তারা চেয়েছিল যাত্রা শুরু করে ইতালি পাড়ি দিয়ে আল্পস টপকে তারা গল অঞ্চলে পালিয়ে যাবে(বর্তমান দিনের ফ্রান্স, তৎকালীন সময়ে এর বেশিরভাগ অঞ্চলই ছিল রোমান নিয়ন্ত্রণের বাইরে)। প্লুটার্খের ভাষায়ঃ স্পার্টাকাস বেশ প্রজ্ঞাবানের মত একটি সিদ্ধান্ত নিলেন যে তারা পুরো রোমান সাম্রাজ্যের সাথে যুদ্ধ করে পেরে উঠবে না, সুতরাং এর থেকে ভাল হয় ফৌজ নিয়ে আল্পসের দিকে অভিযান করা এবং সেটি পাড়ি দিয়ে থ্রেস এবং গল অঞ্চলে যার যার জন্মভূমিতে ফিরে যাওয়া।

দাসফৌজের বিভক্তি

সিনেটের টনক নড়ার পর তারা  দুইজন অধিনায়কের অধীনে দুইটি লিজিওন বাহিনী পাঠালো দাসফৌজের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য, একজন গেলিয়াস পাব্লিকোলা এবং অন্যজন নেয়াস কর্নেলিয়াস লেন্টুলাস ক্লডিয়ানাস। স্পার্টাকাস এই প্রথম তার অভিযাত্রায় কঠিন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়ঃ দশ হাজার লিজিওন সেনাবাহিনী সিসালপাইন গল অঞ্চলের গভর্নর(গল প্রদেশে আল্পসের এই অংশটি রোমানদের দখলে ছিল, বর্তমান উত্তর ইতালি) ক্যাসিয়াস লঙিনাসের নেতৃত্বে দাসদের বিরুদ্ধে রণক্ষেত্রে অবতীর্ণ হলো। রোমানরা এই যুদ্ধে একটি জয়লাভ করেছিল, ক্রিক্সাসের নেতৃত্বে যে দাসফৌজ ছিল তার বিরুদ্ধে। এই সময়কালে দাসফৌজের মধ্যে একটি বিভাজনের তৈরী হয় কারন বিদ্রোহী দলগুলোতে কিছুটা মত-বিভক্তি ঘটেছিল।

বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা বৈচিত্র্যময় দাসশ্রেণী যাদের গোষ্ঠী আলাদা ভাষা আলাদা এমনকি ঈশ্বরও আলাদা, তাদের মধ্যে ঐক্য গঠন করা মোটেও সহজ কাজ ছিলোনা। এই ধরনের ঐক্য ধরে রাখার জন্য বহুগুন সম্পন্ন নেতা হতে হয় যা লাভ করা স্পার্টাকাসের জন্যও হয়ত কঠিন পরীক্ষা ছিল এবং তাতে তিনি সবসময় সফলও হতে পারেননি। ক্রিক্সাস এবং গল অঞ্চলের দাসগোষ্ঠীরা স্পার্টাকাসের সিদ্ধান্ত মেনে নিতে রাজী হয়নি। সম্ভবত প্রথম দিককার এত সাফল্যের কারনে ক্রিক্সাস ইতালি ছেড়ে যেতে রাজী হয়নি। অন্যদিকে স্পার্টাকাস উত্তরাঞ্চলে গল অভিমুখে যাত্রা করতে চেয়েছিল, প্লুটার্খের লেখনীতেও তেমনটাই আমরা দেখতে পাইঃ

সংখ্যায় বৃদ্ধি পাওয়া এবং একের পর এক রণসাফল্যের কারনে তাদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায় অতিমাত্রায়, যার কারনে তারা স্পার্টাকাসের অধীনে উত্তর অভিমুখে যাত্রার বদলে ইতালিতে অবস্থান করেই ইতালি লুট করতে চাচ্ছিল; অন্যদিকে সিনেটের টনক নড়ার পর থেকেই তারা এই বিষয়টিকে আর একেবারেই হেলাফেলা করেনি, ক্রমবর্ধমান আন্দোলন এবং দাসফৌজের শক্তিবৃদ্ধির ব্যাপারটিকে তারা বেশ বিপদজনক হিসেবে ভাবছিল এবং সতর্কতার সাথে মোকাবিলা করার প্রস্তুতি নিচ্ছিল, যেকারনে তারা দুইজন অধিনায়ক পাঠিয়েছিল দুইটি লিজিওন বাহিনী সমেত যাতে করে এই দুঃসাধ্য মামলাটি খালাস করা যায় একেবারে। (প্লুটার্খ, ক্রাসাস)

রোমান ভাষ্যকার প্লুটার্খ উক্ত সমস্যাটির একেবারে মূল ধরতে সক্ষম হয়েছিল। কিছু নেতা তাদের প্রথম দিককার সাফল্যে মত্ত হয়ে গিয়েছিল এবং অতিমাত্রায় আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠেছিল। যেকারনে ক্রিক্সাস স্পার্টাকাসের পক্ষ ত্যাগ করে ত্রিশ হাজার গল এবং জার্মান সৈন্য নিয়ে চলে যায়। এই বিভক্তি ছিল একটি সর্বনাশা ভুলঃ ক্রিক্সাস পরবর্তীতে পাবলিকোলার হাতে পরাজিত হয় যুদ্ধে। গলদেরকে এই ভুলের চরম মাশুল দিতে হয়েছিল, বিশ হাজার গল সেনা নিহত হয়েছিল। দাসফৌজের নওজোয়ানদের মধ্যে বিভক্তি কতটা ভয়ংকর ফলাফল বয়ে আনতে পারে এটি ছিল তার পূর্বাভাস।

ক্রিক্সাসের এই বিশ্বাসঘাতকতামূলক আচরণের পরেও স্পার্টাকাস বেশ সম্মান ও মর্যাদার সহিত শহীদ হওয়া গলদের দাফনকার্য সম্পন্ন করে এবং গল নেতাদের প্রাপ্ত শ্রদ্ধাঞ্জিলরও ব্যবস্থা করে। এমনকি তাদের সম্মানার্থে বন্দী রোমান সেনাদের মধ্য থেকে গ্লাডিয়েটর ঢং এর যুদ্ধক্রীড়ারও ব্যবস্থা করে। এর থেকে বুঝা যায় স্পার্টাকাসের নেতৃত্বমূলক বৈশিষ্ট্য এবং  চরিত্র কতটা উত্তম ছিল। পরবর্তীতে স্পার্টাকাস প্রথমে লেন্টুলাস এবং তারপর পাবলিকোলা দুজনকেই পরাজিত করে। প্লুটার্খের ভাষায়ঃ

স্পার্টাকাসের দল থেকে পথভ্রষ্ট হওয়া জার্মান কিছু দাস সৈন্যরা গেলিয়াসের সেনাবাহিনীর কাছে পরাজিত হয় এবং পরবর্তীতে তাদের প্রায় সবাইকে হত্যা করে গেলিয়াস। কিন্তু লেন্টুলাসের দায়ীত্ব পড়ে স্পার্টাকাসকে আক্রমণ করার, লেন্টুলাস স্পার্টাকাসকে আক্রমণ করেও কোনও সুবিধা করে উঠতে পারেনি বরং লজ্জ্বাজনকভাবে রণেভঙ্গ দিয়ে পালাতে হয় তাকে, যার ফলে তার সৈন্যসামন্তের মালসামানা সব স্পার্টাকাসের দখলে চলে আসে। এরপর স্পার্টাকাস আল্পসের দিকে যাত্রা শুরু করলে পথিমধ্যে সেই অঞ্চলের ম্যাজিস্ট্রেট ক্যাসিয়াসের দশ হাজার সেনার মুখোমুখি হয় আবারও, এখানেও বিজয়লাভ করে স্পার্টাকাস এবং ক্যাসিয়াস তার নিহত সেনাদের ফেলে রেখে কোনওমতে নিজের প্রাণ বাঁচিয়ে পালায়।

এই পরাজয়গুলো রোমান আত্মমর্যাদার উপর কষাঘাত হেনেছিল এবং সিনেটের আত্মবিশ্বাস নাড়িয়ে দিয়েছিল। শুধুমাত্র তাদের সেনাবাহিনীই চুরমার হয়নি, তাদের সাথে বহন করা রোমান “ফ্যাসেস”গুলোও এখন স্পার্টাকাসের দখলে চলে এসেছিল(এখানে fasces বলতে রোমান শাসকশ্রেণীর একটি পবিত্র চিহ্ন বুঝানো হয়েছে যা তারা বহন করতো, মূলত এই fasces শব্দ থেকেই fascism শব্দের উৎপত্তি)। মিউটিনা অঞ্চলেও(বর্তমান মডেনা) দাসফৌজ সিসালপাইন গলের গভর্নর গাইয়াস ক্যাসিয়াস লঙিনাসকে পরাজিত করে। এই সবকিছু মূলত একটিই সংকেত পাঠাচ্ছিল রোমান সিনেটের কাছেঃ দাসফৌজের নেতারা অপরাজেয় হয়ে উঠছে ধীরে ধীরে।

দাসফৌজের যাত্রার অভিমুখ বদলানো

এরপরে যা ঘটেছিল তা সম্ভবত ইতিহাসের সবথেকে রহস্যজনক ঘটনাবলীর একটি। দাসফৌজ আল্পসের খুব কাছাকাছি চলে গিয়েছিল এবং চাইলেই তারা সেটি পাড়ি দিয়ে রোমান সাম্রাজ্যের বাইরে গল এবং জার্মানি অঞ্চলে যেতে পারতো, অথবা স্পেনে দানা বাঁধা বিদ্রোহী আন্দোলনেও যোগ দিতে পারতো। কিন্তু এরপর কোনও এক কারনে তারা পরিকল্পনা পাল্টে ফেলে এবং স্পার্টাকাস সেখান থেকে পিছু হটে, তার দাসফৌজ আবারও ইতালির দিকে অভিযান চালায়। এই পরিকল্পনা পাল্টে ফেলার কারন কী? আমাদের কাছে এর উত্তর নেই। হয়তো  এতবড় সেনাবাহিনী নিয়ে আল্পস পাড়ি দেয়ার মালসামানা ছিলোনা তাদের কাছে, অথবা হয়তো দাসফৌজ তাদের ক্রমবর্ধমান সাফল্যে মত্ত হয়ে ইতালিয়ান শহরগুলো লুট করার জন্য মেতে উঠেছিল।

যাইহোক, এরপর থেকে আর কোনও ঘটনাই স্পার্টাকাসের অনুকূলে ঘটেনি। ইতোমধ্যে স্পার্টাকাসের সৈন্যশিবিরে বহুসংখ্যক আবালবৃদ্ধবনিতা অনুসারীও এসে জুটেছিল, যারা তাদের নিপীড়নের জীবন থেকে পালিয়ে এই বিদ্রোহী গ্রুপে যোগদান করেছিল নতুন করে বাঁচার আশায়। এই বেসামরিক অনুসারীদের সংখ্যা প্রায় দশ হাজারেরও বেশি হবে। যাদের সবার খাদ্য যোগানের দায়ভার ছিল স্পার্টাকাসের উপর। এই ব্যাপারটি হয়তো স্পার্টাকাসের আন্দোলনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে ক্রমশ জটিল করে তুলেছিল। পাশাপাশি রোমানরাও আর স্পার্টাকাসের দাসফৌজকে অবহেলার বিষয় হিসেবে খাটো মনে করেনি।

স্পার্টাকাসের ক্রমবর্ধমান বিজয় সম্পর্কে অবগত হওয়ার পর রোমান সিনেট ক্ষোভে ফেটে পড়লো রিপাবলিকের সেনা কর্মকর্তা এবং গভর্নরদের উপর, সিনেট তাদেরকে নির্দেশ দিল আর এই বিষয়ে মাথা না ঘামাতে। অন্যদিকে তারা এই বিষয়টি মোকাবিলার দায়ীত্ব দিল মার্কাস লিসিনিয়াস ক্রাসাস এর উপর। ক্রাসাস ছিলো রোমের সবথেকে ধনী ব্যক্তিদের একজন, উচ্চাকাঙ্ক্ষী রাজনীতিবিদ এবং যশ ও খ্যাতির লোভে মত্ত। তবে ক্রাসাস তার প্রতিপক্ষকে খাটো করে দেখার মত ভুল করেনি। তার পরিকল্পনা ছিল ধীরে ধীরে সৈন্যবাহিনী গড়ে তোলা এবং তাৎক্ষনিক কোনও সম্মুখ সমর এড়িয়ে থাকা, কারন তিনি এ বিষয়ে আত্মবিশ্বাসী ছিলেন রোমের যে পরিমান ক্ষমতা ও সম্পদ রয়েছে তার সামনে এই বিদ্রোহী গ্রুপের চূড়ান্তভাবে বিজয়ী হবার কোনও সম্ভাবনা নেই।

তবে তার বাহিনীতে খ্যাতির লোভে যোগদানকৃত অনেকেই এই বিষয়ে অবগত ছিল না যে তারা কত ভয়ংকর শত্রুর মোকাবিলা করতে যাচ্ছে রণক্ষেত্রে। প্রায় সকলেই ছিল বড়লোকের আলালের ঘরের দুলাল যুবক। শিয়াল পাকড়াও করার মত পরিশ্রম করতে হবে দাসফৌজকে পরাজিত করতে হলে এটি তাদের খেয়ালেও আসেনি প্রথমে। প্লুটার্খের বিবৃতিতে দেখতে পাইঃ বহুসংখ্যক অভিজাত যুবকেরা তার বাহিনীতে যোগ দিয়েছিল, খানিক বন্ধুত্বের খাতিরে এবং খানিক মর্যাদালাভের খাতিরে।

পাইসেনামের সীমান্ত অঞ্চলে ক্রাসাস তার ঘাঁটি বসিয়েছিল এবং আশা করছিল স্পার্টাকাসের দাসফৌজ এই এলাকা অতিক্রম করতে আসবে, তিনি তার লেফটেন্যান্ট মুম্মিয়াসকে দুইটি লিজিওন স্কোয়াড সহ পাঠিয়ে দিল শত্রুপক্ষের গতিবিধি পর্যবেক্ষনের জন্য, কিন্তু তাদেরকে কড়া নির্দেশ দিয়ে দিয়েছিল যাতে তারা সরাসরি কোনও দাঙ্গাহাঙ্গামায় যুক্ত না হয় দাসফৌজের সাথে। খুবই শান্তভাবে নিশ্চুপ ধীর গতিতে তাদেরকে একটি ক্ষুদ্র পাহাড়ে ঘাঁটি গেড়ে থাকতে বলা হয়েছিল যাতে করে শত্রুপক্ষ টের না পায়।

অতিমাত্রায় আত্মবিশ্বাসী হয়ে প্রথম সুযোগেই ক্রাসাসের লেফটেন্যান্ট সম্মুখ সমরে নেমে গেল স্পার্টাকাসের বাহিনীর বিরুদ্ধে, এবং তাতে চরম পরাজয়ের শিকার হলো। হয়তো তাদের সবাইকেই মেরে ফেলা হতো যদি না ঠিক সময়ে ক্রাসাস তার বাহিনী নিয়ে এসে যুদ্ধে যোগ দিত। এটি ছিল সবথেকে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। ক্রাসাসের বাহিনীর প্রচুর সৈন্য নিহত হয় এবং বাকিরা রণেভঙ্গ দিয়ে নিজেদের প্রাণ বাঁচিয়ে পালিয়ে যায়। অন্যদিকে দাসফৌজের সাহসিকতার বিবরণ দিতে গিয়ে প্লুটার্খ লিখেছিলেনঃ “বারো হাজার তিনশো বিদ্রোহীদের মধ্যে যাদেরকে ক্রাসাস হত্যা করেছিল তাদের মধ্যে মাত্র দুইজনের শরীরে আঘাত ছিল পিঠের দিকে, বাকি সবাই সম্মুখ সমর থেকে এক চুলও নড়েনি বরং বীরত্বের সাথে নিজেদের বুক এগিয়ে দিয়ে লড়াই করে যুদ্ধক্ষেত্রেই প্রাণ দিয়েছিল।”

দাসফৌজের এই বীরত্বের সামনে রোমান ভীরু সৈনিকেরা প্রথমদিকে নাজুক হয়ে পড়েছিল এটাই স্বাভাবিক, যেকারনে ক্রাসাস প্রাচীণ রোমের ডেসিমেশন(দশজনের প্রতি দলের মধ্যে একজনকে বাকি সবাই মিলে হত্যা করতে হবে) নামক একটি কঠোর শাস্তিবিধি আবার ফিরিয়ে আনলো তার সৈন্যশিবিরে। সেনাবাহিনীর মধ্যে কঠোর শৃঙ্খলাবোধ তৈরী করার জন্য প্রথমে ক্রাসাস মুম্মিয়াসকে তীব্র ভর্ৎসনা করলেন। এরপর তিনি সৈন্যদের হাতে আবার নতুন অস্ত্র তুলে দিলেন এবং এই অস্ত্রের জন্য তাদের নিজেদের গাটের পয়সা নিলেন, যাতে করে এরপর তারা কখনও এই অস্ত্র ফেলে দিয়ে না পালায়।

এরপর তিনি পাচশো সৈন্যকে পঞ্চাশটি ছোট ছোট দশজনের দলে ভাগ করে দিলেন, এবং প্রতিদলের একজনকে বাকি নয়জন মিলে হত্যা করার নির্দেশ দিলেন। এই ধরনের নৃশংস নির্দেশ ও আচরণের মাধ্যমে তিনি বাকিদের বুঝিয়ে দিলেন এই যুদ্ধ কতটা গুরুতর এবং গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। প্লুটার্খের বর্ণনায়ঃ “সৈন্যদেরকে বিভিন্ন ধরনের নৃশংস কর্মকান্ডের নির্দেশ দিলেন এবং তাতে লিপ্ত হতে বাধ্য করলেন, আর পুরো সৈন্যশিবিরকেও দর্শক হিসেবে থাকার নির্দেশ দিলেন।” এই ঘটনার পর থেকে রোমান সৈন্যরা যতটা না দাসফৌজকে ভয় পেত, তার থেকে বেশি ভয় পেতে শুরু করলো তাদের সেনাপতিকে।

বাগবন্দী

৭২খ্রিস্টপূর্বাব্দের শেষদিকে স্পার্টাকাস এবং তার দাসফৌজ মেসিনা প্রণালীর(ইতালি ও সিসিলিকে আলাদা করে যে প্রণালী) কাছে রেগিয়াম অঞ্চলে ঘাটি তৈরী করে। স্পার্টাকাস চিলিচিয়ান জলদস্যুদের সাথে চুক্তি করে যাতে করে তার দাসফৌজ তাদের জাহাজে মেসিনা প্রণালী পাড়ি দিয়ে সিসিলি তে পৌঁছাতে পারে। প্লুটার্খের ভাষায়ঃ “তিনি এরপর চিন্তা করলেন সিসিলি তে পাড়ি জমানোর, যেখানে তিনি তার দুই হাজার সৈন্যের দাসফৌজ নিয়ে নতুন উদ্যমে দাসবিদ্রোহ শুরু করার সুযোগ পাবে, কারন সেখানে কিছুদিন আগেই একটি দাসবিদ্রোহ শেষ হয়েছিল এবং কিছুটা বিদ্রোহের আগুন এখনও নিভু নিভু করে জ্বলছিল, স্পার্টাকাসের পরিকল্পনা ছিল সেটিকে বাড়িয়ে তোলার। কিন্তু জলদস্যুরা তার সাথে চুক্তি করে টাকা নেয়ার পর প্রতারণা করে এবং স্পার্টাকাসের বাহিনীকে ছাড়াই তারা পালিয়ে যায়।”

এই পরিকল্পনা স্পার্টাকাসের ট্যাকটিক্স এবং স্ট্রাটেজি সম্পর্কিত চমৎকার দক্ষতার প্রতিফলন। যদি তারা সিসিলিতে পৌঁছাতে পারতো তাহলে সেখানে নতুন করে দাসবিদ্রোহ দানা বাঁধার সম্ভাবনা ছিল, রোমান শাসনের বিরুদ্ধে তারা হয়তো উক্ত দ্বীপটিকে স্বাধীন রাখতে পারতো। আল্পস পাড়ি দেয়ার পরিকল্পনাটি ব্যর্থ হওয়ার পর সরাসরি রোমের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যাওয়া ছাড়া হয়তো এটিই তাদের হাতে একমাত্র অপশন ছিল। কিন্তু এই পরিকল্পনাটিও ব্যর্থ হয় জলদস্যুদের প্রতারণার কারনে। হয়তো ক্রাসাসের এজেন্টরা জলদস্যুদের ঘুষ দিয়েছিল, অথবা হয়তো জলদস্যুরাই চায়নি স্পার্টাকাসের দাসফৌজকে সাহায্য করে পুরো রোমান সেনাবাহিনীর শত্রু হয়ে উঠতে। কারন যেটাই হোক, এর ফলে স্পার্টাকাসের দাসফৌজ ক্যালাব্রিয়াতে ফাঁদে আটকে পড়ার মত পরিস্থিতির শিকার হলো।

এই ফাঁদে পড়ে যাওয়াটা স্পার্টাকাস এবং তার দাসফৌজের জন্য কতটা বিধ্বংসী ছিল তা আমরা সহজেই অনুভব করতে পারি। সিসিলিতে পালানোর পরিকল্পনা ব্যর্থ হওয়ায় দাসফৌজ ধীরে ধীরে শংকিত হয়ে উঠেছিল। ৭১খ্রিস্টপূর্বাব্দের গোড়ার দিকে ক্রাসাস আটটি লিজিওন বাহিনী পাঠিয়েছিল তাদের বিরুদ্ধে। অন্যদিকে স্পেনের বিদ্রোহী নেতা কুইন্টাস সেরটোরিয়াসের হত্যাকান্ড ঘটার পর উক্ত প্রদেশ থেকে রোমান সিনেট পম্পেইকেও ডেকে পাঠানো হয় স্পার্টাকাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য। এবং বিজয় একেবারে সুনিশ্চিত করতে তারা মেসিডোনিয়া থেকে মার্কাস টেরেন্টিয়াস ভারো লুসুলাসকেও ডেকে পাঠালো। যে রোমান সিনেট প্রথমদিকে দাসফৌজকে আমলেই নেয়নি, তারাই এখন সর্বশক্তি দিয়ে দাসফৌজের বিরুদ্ধে আদাজল খেয়ে যুদ্ধে অবতীর্ণ হলো।

এইসময়ে একটি ছোট দাঙ্গার পর স্পার্টাকাস একজন রোমান বন্দীকে ক্রুশবিদ্ধ করে মৃত্যুদন্ড দিয়েছিল এমনটা জানা যায়। রোমান প্রোপাগান্ডা প্রচারকেরা এই শাস্তিকে বিদ্রোহীদের “বর্বর এবং নিষ্ঠুর” স্বভাব বলে প্রচার করেছিল। তবে, ক্রুশবিদ্ধকরণ দাসদের জন্য একেবারেই স্বাভাবিক শাস্তি ছিল তৎকালীন সময়ে। এবং ইতিহাসের প্রতিটি পাতাই স্বাক্ষী দেয় যে দাসেরা নয় বরং শাসক-মালিক শ্রেণীই বারংবার নিজেদের বর্বরতা এবং নিষ্ঠুরতা চর্চা করেছে দাসদের উপর। স্পার্টাকাসের এই আচরণ একেবারে পরিকল্পিতভাবে বিদ্রোহী মনোভাব প্রকাশের জন্যও হতে পারে, যেহেতু ক্রুশবিদ্ধকরণ একটি নিষ্ঠুর শাস্তি ছিল এবং এই শাস্তি রোমান নাগরিকদের দেয়া হতোনা। এই আচরণের মাধ্যমে স্পার্টাকাস তার শত্রুপক্ষকে এই খবরটিই দিলঃ দাসশ্রেণীর প্রাণের কোনও মূল্য নেই এমনটাই তোরা ভেবে থাকিস, কিন্তু এর জন্য চরম মূল্য পরিশোধ করতে হবে তোদের। সকল খবরের মত এই খবরটিও রোমানরা বেশ তোরজোরের সহিত প্রচার করেছিল এবং দাসদের বিরুদ্ধে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধকে বৈধ করার প্রচেষ্টা চালিয়েছিল। কিন্তু আসলে তাদের এসব করার জন্য কোনও বৈধ অজুহাত না দেখালেও চলতো, কারন তারা যা করার তা এমনিতেই করতো এবং সেটার সিদ্ধান্তেও তারা অটল ছিলঃ এই দাসফৌজকে এমন কঠোর শিক্ষা দিতে হবে তা যেন পৃথিবীর ইতিহাসে এক দৃষ্টান্ত হয়ে থাকে!

অতিমাত্রায় আত্মবিশ্বাস দাসফৌজের পরাজয়ের একটি মুখ্য কারন হিসেবে কাজ করেছিল, প্লুটার্খের ব্যাখ্যায় দেখা যায়ঃ

"স্পার্টাকাস কিছুটা ছত্রভঙ্গ অবস্থাতে তার দাসফৌজ নিয়ে পেটেলিয়া পর্বতমালার দিকে যাত্রা করে, কিন্তু ক্রাসাসের অফিসার কুইন্টিয়াস এবং স্ক্রোফা তাদের পিছু নিয়ে আক্রমণ করে। কিন্তু স্পার্টাকাস যখন ঘুরে পাল্টা আক্রমণ চালায় তখন কুইন্টিয়াস স্ক্রোফার দল পরাজিত হয়, কুইন্টিয়াস কোনওমতে প্রাণ নিয়ে পালায় রোমান জাজ স্ক্রোফাকে ফেলে রেখেই, কারন স্ক্রোফা আহত অবস্থায় পড়েছিল, তাকে তুলে নেয়ার সময়টুকুও পায়নি রোমান সেনাবাহিনী। এই ছোট জয়টিই অবশ্য স্পার্টাকাসের বুদ্ধিমত্তাকে কলুষিত করেছিল, কারন এতদিন তিনি দাসফৌজকে যতটা কম যুদ্ধ করে পারা যায় ততটা কম যুদ্ধই করতে বলছিলেন, কিন্তু এখন তিনি আর যুদ্ধে কোনওপ্রকার বাধা দিলেন না, বরং সকল শক্তি দিয়ে যা কিছু আছে তাই নিয়ে ঝাপিয়ে পড়ার নির্দেশ দিলেন অফিসারদেরকে। তারা  লুসেনিয়ার পথ ধরে অভিযান চালাতে লাগলো রোমের দিকে, এই সুযোগের অপেক্ষাতেই ছিল ক্রাসাস।"

সর্বদা সুচতুর ক্রাসাস কোনও সম্মুখ সমরে গেলেন না কারন দাসফৌজের শক্তি সামর্থ্য সম্পর্কে তিনি ইতোমধ্যে ভালোই অবগত হয়েছিলেন পূর্বেকার পরাজয়গুলো দেখে। তিনি আক্রমণের বদলে তার বাহিনীকে ইস্থমাসের লাইন ধরে বিশাল দেয়াল গাঁথতে বললেন যাতে করে খাদ্য সাপ্লাইয়ের অভাবে দাসফৌজ নতি স্বীকার করে। যত ধরনের প্রযুক্তিগত শক্তি ছিল তৎকালীন রোমে তা সবকিছুই নিয়োজিত করা হচ্ছিল এই দাসফৌজকে পরাজিত করার কাজে। প্লুটার্খের ভাষায়ঃ

খুব স্বল্প সময়ের মধ্যে তিনি এই বিশাল জটিল কাজটি করিয়ে ফেললেন তার বাহিনীর দ্বারা, পুরো এলাকাটি ঘিরে ফেললেন ষাট হাজার মিটার দীর্ঘ এবং পনেরো ফুট উচ্চ দেয়াল তুলে। যা একইসাথে উচু এবং টেকসই একটি দেয়াল। এই দেয়াল তোলার কার্যক্রমটির মাধ্যমে তিনি এক ঢিলে দুই পাখি মারলেনঃ একদিকে তার সৈন্যরা অলস সময় কাটিয়ে নিজেদের শরীরে চর্বি জমানোর সুযোগ পেলোনা, অন্যদিকে শত্রুর বিভিন্ন সাপ্লাইও বন্ধ করে দেয়া গেল।

তবে এই সব চেষ্টাই বৃথা গেল। এতসব বাধাবিপত্তি পাড়ি দিয়ে স্পার্টাকাস আবারও তার দাসফৌজ নিয়ে হানা দিল শেষবারের মত, তিনি হঠাৎ করেই একটা অলৌকিক কৌশল অবলম্বনের চেষ্টা করলেন এবং অনেকটা সফলও হলেন। এক তুষার ঝড়ের রাতে তিনি তার সৈন্যদের নিয়ে বেড়িয়ে পড়লেন এবং দেয়ালের একটি অংশের পিছন দিক থেকে মাটি ও গাছের গুড়ি ফেলিয়ে উচু করে লাগলেন যাতে দেয়াল সহজে টপকানো যায়। এই কৌশলে তার বাহিনী তিনভাগের একভাগ দেয়াল টপকে গেল। তবে এটা ছিল অনেকটা মৃত্যুর আগে শেষ কামড়ের মত, অর্থাৎ এটিই ছিল শেষ প্রচেষ্টা দাসফৌজের। তারা ক্রাসাসের তোলা দেয়াল টপকে ক্রাসাসের সৈন্যশিবিরকে ছত্রভঙ্গ করে দিয়ে ব্রুন্ডিসিয়াম(বর্তমান ব্রিন্ডিসি) এর দিকে এগিয়ে গেল, যেখানে লুসুলাসের বাহিনী এগিয়ে আসছিল।

ক্রাসাস খুবই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিল যখন সে দেখেছিল যে তার পাহাড়ায় বসানো সৈন্যশিবির ছত্রভঙ্গ করে দিয়ে দাসফৌজ সরাসরি রোমের দিকে অভিযান করছিল। বাস্তবিকভাবেই এটাই হয়তো দাসফৌজের হাতে একমাত্র রাস্তা ছিল, শেষবারের মত রোমান রিপাবলিককে আঘাত করা। কিন্তু এটিও সম্ভবপর হয়ে ওঠেনি পুরোপুরিভাবে কারন আবারও দাসফৌজের মধ্যে একতার ফাটল ধরলো। আবারও স্পার্টাকাসের ফৌজের একটি অংশ মূলবাহিনী ছেড়ে লুসানিয়ান হ্রদের ধারে থেকে গেল। এবং আরও একবার বিভক্তির মূল্য পরিশোধও করতে হলো। ক্রাসাস এই লুসানিয়ান হ্রদের ধারে থেকে যাওয়ার দাসফৌজের দলটির উপর হামলে পড়লো। তিনি সবাইকে হত্যা করতে যাচ্ছিলেন কিন্তু এমন সময় স্পার্টাকাসের মূল বাহিনী হঠাৎ করে রক্ষাকর্তা হিসেবে হাজির হয় এবং তারা সকলে মিলে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়।

শেষ যুদ্ধ

প্রথমে খানিকটা পিছু হটলেও এটা ক্রাসাসের কাছে খুব স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল যে দাসফৌজ বেশ একটা বেকায়দা পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছে। ক্রাসাস বুঝতে পারছিল যে তার বিজয় খুবই সন্নিকটে, সিনেটকে চিঠি দিয়ে থ্রেস থেকে লুসুলাস এবং স্পেন থেকে পম্পেই কে সাহায্যের জন্য ডেকে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে তার আফসোস হচ্ছিল। এটি তৎকালীন রাজনীতিবিদ হিসেবে খুবই স্বভাবসুলভ একটি মনোভাব, কারন তিনি এই যুদ্ধে বিজয় লাভের ব্যাপারটিকে পরবর্তীতে ব্যবহার করে নিজের মর্যাদা বৃদ্ধি এবং উচ্চ রাজনৈতিক পদগ্রহণের আশা করছিলেন, যেটা আমরা জুলিয়াস সিজারের ক্ষেত্রেও দেখতে পাই পরবর্তী ইতিহাসে। যদি চূড়ান্ত যুদ্ধের ঠিক আগে দিয়ে অন্যান্য সেনাপতি এসে যোগদান করে তাহলে বিষয়টা এমন দেখাবে যে, ক্রাসাস নয় বরং উক্ত সেনাপতিদের যোগদানের কারনেই যুদ্ধে বিজয় লাভ সম্ভব হয়েছে এবং এটি ক্রাসাসের কৃতিত্ব কমিয়ে দিবে। এটাই হয়েছিল ঠিক এক্ষেত্রে। চূড়ান্ত যুদ্ধে ক্রাসাস বিজয় লাভ করলেও যশখ্যাতি লাভ করেছিল পম্পেই।

ক্রাসাস একারনে যুদ্ধটি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শেষ করার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠেছিলঃ

পম্পেই যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে যাচ্ছে এই খবর ছড়িয়ে পড়া মাত্রই জনগণ এই যুদ্ধের কৃতিত্ব পম্পেইয়েরই হবে এমনটি আলাপ করতে শুরু করে, তারা ভাবতে থাকে পম্পেই এসে আক্রমণ করা মাত্রই শত্রুপক্ষের পরাজয় ঘটবে এবং এই যুদ্ধ শেষ হবে। একারনে ক্রাসাসও দ্রুতই একটি চূড়ান্ত সম্মুখ সমরের মাধ্যমে দাসফৌজকে কাবু করতে চাচ্ছিল, তিনি দাসফৌজের খুব নিকটে গিয়ে নিজের সৈন্যশিবির তৈরী করে তাদেরকে ঘিরে ফেললেন; কিন্তু দাসফৌজ আবারও আকস্মাৎ হানা দিলো এবং কমান্ডিং অফিসারদের উপর আক্রমণ চালালো। (প্লুটার্খ, ক্রাসাস)

ক্রাসাসের আর্মি ছিল অধিকতর শক্তিশালী এবং সে নিজেও চূড়ান্ত যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার জন্য উদগ্রীব হয়েছিলেন। তিনি স্পার্টাকাস ফৌজের খুব নিকটে গিয়ে সৈন্যশিবির তৈরী করলেন, এটি দাসফৌজকে যুদ্ধে উস্কে দেয়ার জন্যই করলেন। দাসফৌজও এই উস্কানিতে সাড়া দিয়েছিল। স্পার্টাকাস এটা বুঝতে পেরেছিলেন যে সবদিক থেকেই নতুন নতুন সৈন্যদল এসে যোগ দিচ্ছে দাসফৌজকে কাবু করার জন্য, সুতরাং এখন আর পিছু হটবার কোনও সুযোগ নেই। যুদ্ধ বিলম্ব করা মানে রোমানদের শক্তিই বৃদ্ধি করা। এটাই মাহেন্দ্রক্ষণ, এবং এখানেই স্পার্টাকাসের অতিমানবিক শক্তির শেষ পরীক্ষা দিতে হবে, সেভাবেই তারা প্রস্তুতি নিল। প্যারিস কম্যুনের বীরত্বমূলক বিদ্রোহের বিবরণ দিতে গিয়ে কার্ল মার্ক্স বলেছিলেন “আরশ কাঁপিয়ে তোলা”, এখানেও দাসফৌজ সেই আরশ কাঁপিয়ে তোলার প্রস্তুতিই নিচ্ছিল। স্পার্টাকাস তার ফৌজকে একত্রিত করলেন এবং শেষ লড়াইয়ের জন্য তাদের যোদ্ধাসত্ত্বাকে জাগিয়ে তুললেন।

আমরা বর্তমান সময়ে বসে আন্দাজ করে নিতে পারি এই ভাগ্যনির্ধারক মুহূর্ত কতটা উত্তেজনাপূর্ণ ছিল, যেখানে পুরো দাসফৌজ এবং দাসবিদ্রোহের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে এই একটি যুদ্ধের উপর। তবে এই উত্তেজনাপূর্ণ মুহূর্তেও স্পার্টাকাস ঠান্ডা মাথায় ধীরস্থির ভাবেই তার ফৌজ গোছাতে লাগলেন এবং যুদ্ধের নকশা করলেন। এরপর যুদ্ধ শুরুর আগে যে ঘটনাটি তিনি ঘটিয়েছিলেন সেটা ইতিহাসে বিরল এক মুহূর্ত। যুদ্ধের আগে যখন তার ঘোড়া নিয়ে আসা হলো যুদ্ধে অবতীর্ণ হবার জন্য, তিনি তার তলোয়ার বের করে দাসফৌজের সবার সামনে তার ঘোড়াটিকে হত্যা করলেন, তিনি বললেনঃ যদি যুদ্ধ জিতে যাই তাহলে শত্রুপক্ষের অনেক উত্তম ঘোড়া আমি পাবো, কিন্তু যদি হেরে যাই তাহলে আর কোনও ঘোড়ারও দরকার হবেনা আমার। তিনি এই আচরণের মাধ্যমে শুধুমাত্র নিজের বীরত্বই নয় বরং তিনি সবাইকে এই বার্তাটিও পৌঁছালেন যেঃ এই  লড়াই আমাদের বাঁচা মরার লড়াই।

শেষবারের মত দাসফৌজ জানপ্রাণ দিয়ে লড়াই করে গেল সাহসিকতার সাথে, এমনকি রোমান ইতিহাসবিদরাও এটিকে অস্বীকার করতে পারেনা। কিন্তু এই যুদ্ধের ফলাফল আগে থেকেই নির্ধারিত ছিল এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। রোমান ঐতিহাসিকদের মতে, স্পার্টাকাস তার ফৌজ নিয়ে একেবারে রোমান সৈন্যব্যুহ ভেদ করে ক্রাসাসের নিকটে চলে গেল। শত্রুপক্ষের প্রতিটি মরণঘাতী আঘাত পাড়ি দিয়ে আহত অবস্থায় স্পার্টাকাস এগিয়ে গেলেন সামনের দিকে তবে তিনি ক্রাসাসকে ধরতে পারলেন না, তার আগেই দুইজন সেনাপতি স্পার্টাকাসের উপর হামলে পড়লো এবং নিহত হলো স্পার্টাকাসের হাতে। শেষ পর্যন্ত স্পার্টাকাস তার ফৌজ থেকে আলাদা হয়ে পড়লো, একাই যুদ্ধক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে ছিল শত্রুদের ঘেরাও এর মাঝে। তিনি বীরত্বের সহিত নিজের আত্মরক্ষা করতে লাগলো শত্রুদের ঠেকিয়ে দিয়ে, যতক্ষন পর্যন্ত তার প্রাণ ছিল ততক্ষন সে লড়েছিল। রোমান ইতিহাসবিদ আপ্পিয়ানের বয়ানেঃ

স্পার্টাকাস গুরুতরভাবে আহত হয়েছিল, তার উরুতে বর্শা দিয়ে আঘাত করা হয়েছিল এবং তিনি হাটু গেঁড়ে বসে পড়তে বাধ্য হয়েছিল, একহাতে তিনি তার সামনে ঢাল তুল ধরে অন্যহাতে তলোয়ার দিয়ে নিজের আত্মরক্ষা করে যাচ্ছিলেন এবং একসময় ধীরে ধীরে সৈন্যরা তাকে ঘিরে ধরে হত্যা করলো।(আপ্পিয়ান সিভিল ওয়ার্স)

যুদ্ধের পরপর লিজিওন বাহিনী প্রায় তিন হাজার রোমান বন্দী খুঁজে পায় এবং তাদেরকে উদ্ধার করে, যারা সবাই অক্ষত অবস্থায় ছিল। রোমান বন্দীদের সাথে দাসফৌজ যে সভ্য আচরণ করেছিল তা স্পার্টাকাসের অনুসারীদের বেলায় কপালে জোটেনি রোমানদের কাছ থেকে। ক্রাসাস ছয় হাজার দাসকে ক্রুশবিদ্ধ করে কাপুয়া থেকে রোমে যাওয়ার ২০০কিলোমটার রাস্তার দুধারে। ব্রুন্ডিসিয়াম থেকে রোমে যাওয়ার রাস্তায় তাদের লাশ ফেলে রাখা হয় দুধারে। পরবর্তীতে এই লাশগুলোকে কী করা হবে সে সম্পর্কে ক্রাসাস কোনও নির্দেশ না দেয়ার ফলে বছরের পর বছর লাশগুলো রাস্তার দুধারেই পড়ে ছিল এবং এক ছমছমে পরিবেশের সৃষ্টি করে রেখেছিল।

প্রায় পাঁচ হাজার দাস পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিল। তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে উত্তরের দিকে লুসেনিয়াতে সিলারুস নদীর তীর ধরে এগিয়ে যায় যেখানে তারা রোমান আইবেরিয়া থেকে ফেরত আসা পম্পেই এর সম্মুখীন হয়। ক্লান্ত এই দাসেরা এখন মুখোমুখি হয়েছিল একদম নতুন উদ্যমী সুপ্রশিক্ষণপ্রাপ্ত আত্মবিশ্বাসী লিজিওন বাহিনীর। পম্পেই এইসকল দাসকে নির্বিচারে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে এবং পরবর্তীতে এদের ব্যবহার করে যুদ্ধজয়ের কৃতিত্বে নিজের ভাগ বসায়।

তাৎক্ষনিকভাবে পম্পেই সিনেটকে চিঠি লিখে এই জয় নিজের বলে দাবী করেঃ যদিও ক্রাসাস একটি আকস্মিক সম্মুখ সমরে দাসফৌজকে পরাজিত করেছে, কিন্তু এই যুদ্ধটির সমাপ্তি হয়েছে তার(পম্পেই) নিজের হাতেই। যার ফলে পরবর্তীতে এই যুদ্ধের আসল কৃতিত্ব পম্পেইকেই দেয়া হয় এবং তিনি সেরটোরিয়া বা স্পেনে যে সাফল্য লাভ করেছিল তার থেকেও বেশি মর্যাদা তাকে দেয়া হয়। অন্যদিকে ক্রাসাসকে বহুল প্রতীক্ষিত এই যুদ্ধের পুরো কৃতিত্ব থেকে বঞ্চিত করা হয়। এভাবেই রোমের নায়ক “মহান” পম্পেই এর উত্থান হয়েছিল।

এই চরম অকৃতজ্ঞতাই আমাদেরকে দাসমালিক রোমান শাসকগোষ্ঠীর চরিত্র সম্পর্কে কিছুটা আভাস দেয়। এই সম্পদশালী খচ্চর এবং মুনাফিকরা পরবর্তীতে এটা কখনোই স্বীকার করতে রাজী হয়নি যে স্পার্টাকাস তাদেরকে কতবড় হুমকির মুখে ফেলেছিল। কয়েকমাস পরেই অভিজাত সিনেটররা এটা ভুলে গেল যে স্পার্টাকাস কত ভয়ংকর একটি হুমকি ছিল তাদের জন্য কিছুদিন আগেও। দাসফৌজের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কীভাবে কারও মর্যাদালাভের পথ হতে পারে?

যুদ্ধে মর্যাদালাভের জন্য মরীয়া হয়ে ওঠা ক্রাসাস আবারও প্রচেষ্টা চালালেন, তবে এবার এশিয়াতে, যেখানে তিনি বেশ অপমানজনক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে সুযোগ্য মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছিলেন। পম্পেই পরবর্তীতে সিজারের বিরুদ্ধে গৃহযুদ্ধ পরিচালনা করতে গিয়ে মিশরে খুন হয়। এসব ঘটনা থেকে কারও মনে ধারনা হতেও পারে যে ইতিহাস কাউকে ক্ষমতা করেনা হয়ত।  ক্রাসাস পম্পেই এদের নাম আজ মানুষ থোরাই মনে রেখেছে! কিন্তু স্পার্টাকাসের নাম ইতিহাসে উজ্জ্বল নক্ষত্রের মত লাখো মানুষের হৃদয়ে সম্মানের সহিত অমর হয়ে রয়েছে।

মিথ এবং বাস্তবতা

স্পার্টাকাসের এই বীরগাঁথা তার মৃত্যুর হাজার হাজার বছর পরেও টিকে আছে। রোমানদের জন্য এই দাসবিদ্রোহ এক চিরশিক্ষা হিসেবে ছিল, কারন এটি এই সতর্কতাই দিয়েছিল, যে সমাজ দাস এবং জনগণকে শোষণ করে গড়ে ওঠে, তা যেকোনও সময় ভেঙে পড়তে পারে। চার শতক পরে ঠিক এমনটিই ঘটেছিল, রোমের পতন ঘটেছিল বার্বারিয়ানদের হাতে। স্পার্টাকাসের স্মৃতি ইতিহাসজুড়ে সবসময়ে নিপীড়িত মানুষের লড়াই এর পক্ষে একটি প্রতীক হিসেবে কাজ করেছে, যারা তাদের নিপীড়ককে দমন করতে উদ্যত হয়েছে বারবার। স্পার্টাকাসের এই গল্প আজকের দিনেও অধিকারের জন্য লড়াইকারীদের অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করে।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় রোজা লুক্সেমবার্গ এবং কার্ল লিয়েবনেস্ট এই রোমান বিপ্লবীর নামেই তাদের গ্রুপের নামকরণ করেছিলেন, স্পার্টাকিস্ট লীগ, এটি কাকতালীয় নয়। কার্ল মার্ক্সও স্পার্টাকাসের একজন ভক্ত ছিলেন। মার্ক্সের মতে স্পার্টাকাস একজন বীরযোদ্ধা ছিলেন, “হয়তো প্রাচীনকালের একমাত্র ব্যক্তি যিনি ছিলেন সবথেকে উত্তম।” ১৮৬১ সালের ২৭শে ফেব্রুয়ারি তারিখে এঙ্গেলসেকে লেখা এক চিঠিতে মার্ক্স বলেছিলেন তিনি স্পার্টাকাস নিয়ে পড়ছেন আপ্পিয়ানের লেখা সিভিল ওয়ার্স অফ রোম বইটিতে, সেখানে তিনি স্পার্টাকাসের বিবরণ দেনঃআমার মতে স্পার্টাকাস প্রাচীনকালের ইতিহাসে সবথেকে মুখ্য এবং উত্তম ব্যক্তি। একজন  মহৎ সেনাপতি, উত্তম চরিত্রের অধিকারী, এবং প্রাচীনকালের প্রলেতেরিয়াতদের একজন প্রকৃত প্রতিনিধি। অন্যদিকে পম্পেই ছিল একজন ইতর (Marx and Engels, Collected Works, Volume 41, p. 265)। ইতিহাস সম্পর্কে যার প্রাথমিক জ্ঞানটুকুও রয়েছে সেও এই বিবরণের সাথে একমত পোষণ করবে।

স্পার্টাকাসের চরিত্র এবং তার বিদ্রোহের ঘটনাবলী বহু আধুনিক সাহিত্যিক এবং রাজনৈতিক লেখকদের জন্য একটি অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে। হাওয়ার্ড ফাস্টের একটি বিখ্যাত উপন্যাস রয়েছে এই দাসবিদ্রোহ নিয়ে। পরবর্তীতে স্টানলি কুব্রিক হাওয়ার্ড ফাস্টের উক্ত উপন্যাসের ভিত্তিতে স্পার্টাকাস(১৯৬০) নামক একটি সিনেমা নির্মাণ করেন। তবে এফ. এ. রিডলির লেখা স্পার্টাকাস বইয়ে তিনি যেভাবে কুব্রিক এবং ফাস্টের দুটি উপন্যাসকেই খারিজ করে দেন, যেটি কোনওভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। মার্ক্সবাদের যান্ত্রিক এবং সংকীর্ণ ব্যাখ্যা যা গাছ দেখতে গিয়ে পুরো জঙ্গল দেখা ভুলে যায়, তার একটি উদাহরণ রিডলির এইরকম আচরণ।

কোনও ইতিহাসের বই লেখা ফাস্টের উদ্দেশ্য ছিলো না, তিনি লিখেছিলেন ঐতিহাসিক উপন্যাস, এবং তা লিখতে গিয়ে তিনি স্বভাববশতই কিছু সৃজনশীলতার প্রয়োগ ঘটিয়েছিলেন, তবে পুরো উপন্যাসে তার বিষয়বস্তুর উদ্দীপনা একেবারে সঠিকভাবেই বহাল ছিল। ঐতিহাসিক উপন্যাস আর ইতিহাস সবসময় একরকম হওয়া বাধ্যতামূলক নয়, বরং ঐতিহাসিক উপন্যাসের কাজই হচ্ছে ইতিহাসের একটি ঘটনাকে মূল সারমর্ম বজায় রেখে সরেসভাবে সৃজনশীলতার সাথে উপস্থাপন করা। অবশ্যই এমন কিছু বিষয় আছে যেগুলো ইতিহাসের সাথে হুবহু মিলবে না, বিশেষ করে সিনেমার বেলায়। যেমন সিনেমার একটি বিখ্যাত দৃশ্যে দেখানো হয়েছিলো যেসব দাসেরা বন্দী হয়েছিল তাদেরকে বলা হচ্ছে স্পার্টাকাস কে সেটি শনাক্ত করার জন্য, কিন্তু এমনটি ঘটেনি বাস্তবে, কারন স্পার্টাকাস যুদ্ধক্ষেত্রেই নিহত হয়েছিল।

কিন্তু আমাদেরকে এটাও মনে রাখতে হবে যে এটি একটি শিল্পকর্ম এবং এখানে ঐতিহাসিক ঘটনাবলীকে নাটকীয় ভঙ্গিতেই প্রকাশ করা হয়ে থাকে। তার থেকেও যেটা গুরুত্বপূর্ণ তা হচ্ছে শিল্প অনেকসময় হুবহু ঐতিহাসিক ঘটনার বিবরণ না দিয়েও আসল সত্যটি তুলে ধরতে পারে। যেমন এক দৃশ্যে দেখা যায় যেখানে প্রত্যেইক দাসই নিজেকে আমিই স্পার্টাকাস বলে দাবী করছিল শাসকগোষ্ঠীর সামনে, এটি হয়তো হুবহু ইতিহাসের মত নয়, কিন্তু এটি একইসাথে একটি নিগূঢ় সত্যও প্রকাশ করে যা প্রায়শই ইতিহাসের অনেক বিপ্লবের সময়েই দেখা যায়। এর দ্বারা বুঝা যায় স্পার্টাকাসের প্রভাব দাসফৌজের মনস্তত্ত্বে কতটা শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল এবং সবাইই স্পার্টাকাসের ব্যক্তিগত স্বাধীনচেতা শক্তিকে নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিয়েছিল। তারাও স্পার্টাকাসের শক্তি এবং স্বাধীনতার জন্য লড়াই এর যে প্রেরণা, তাতে উদ্বুদ্ধ হয়েছিল সবাই। বলা চলে দাসফৌজের প্রতিটি ব্যক্তির মধ্যেও একজন করে স্পার্টাকাসের জন্মলাভ ঘটেছিল। অন্যদিকে দাসদের গণহারে যে ক্রুশবিদ্ধকরণের চিত্রায়ণ সিনেমায় দেখানো হয়েছিল, তা হুবহু ইতিহাসের ঘটনাই।

স্পার্টাকাসের মত এই মহান ব্যক্তি সম্পর্কে আমরা খুব কম তথ্যই পেয়ে থাকি, সেটাও তার শত্রুপক্ষের লিখিত ইতিহাস থেকে। কী জানতে পারি আসলে আমরা উক্ত রেকর্ডগুলো থেকে? যেসব তথ্যাবলী আমরা পাই তার থেকে অন্তত এটুকু বুঝতে পারি যে স্পার্টাকাস একজন চমৎকার সেনাপতি এবং রণকুশলী ছিলেন। সম্ভবত প্রাচীনকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সেনাপতি ছিলেন তিনি। তবে সিনেমা এবং উপন্যাসে যেমনটি দেখানো হয়েছিল যে তার একটি খুব কঠোর শৃঙ্খলাপূর্ণ বাহিনী ছিল তেমনটি নাও হতে পারে হয়তো। যদি তার কোনও পরিষ্কার রাজনৈতিক চিন্তাধারা থেকেও থাকে, সেটি সম্পর্কে আমরা জানি না। তার সেনাবাহিনীর মধ্যে ঐক্যের কিছুটা অভাব দেখা যায় কারন একেবারে অস্তিত্ব রক্ষার জায়গা থেকেই তারা একত্রিত হয়েছিল, এছাড়া আর কোনও এজেন্ডা তাদের ছিল না সম্ভবত। পরবর্তীতে কীভাবে মতানৈক্যের কারনে তার বাহিনীতে ফাটল ধরে সেটিও আমরা দেখতে পাই, যার ফলে শক্তিধর রোমান সেনাবাহিনীর বিজয় নিশ্চিত হয়েছিল।

স্পার্টাকাস কি কম্যুনিজমের আদি পিতা ছিলেন? হাওয়ার্ড ফাস্ট তার উপন্যাসে স্পার্টাকাসের মুখ দিয়ে বলিয়েছিলেনঃ আমরা যাই দখল করবো, তার মালিক আমরা সবাইই হবো, নিজেদের মধ্যে সমান ভাগ করবো, এবং কোনও ব্যক্তিই শুধুমাত্র তার কাপড় অস্ত্র ছাড়া আর কোনওকিছুর একচ্ছত্র মালিকানা দাবী করতে পারবেনা। আমরা এখানে সবকিছু অতীতকালে যেভাবে হতো সেভাবেই পরিচালনা করবো  ফাস্টের মাথায় এই ধারনা কোথা থেকে এসেছিল সেটা আমি জানিনা, কিন্তু ইতিহাসের উক্ত পর্যায়ে এক প্রকারের আদিম সাম্যবাদী এবং কম্যুনিস্ট ধারনার অস্তিত্ব থাকা অসম্ভব কিছু না - যে ধারনাগুলো পরবর্তীতে একইভাবে প্রথমদিককার খ্রিস্টানদের মধ্যেও দেখা যায়।

৭১খ্রিস্টপূর্বাব্দের দাসবিদ্রোহের মধ্যে কিছুটা ইউটোপিয়ান অথবা কম্যুনিস্ট ধারনার প্রভাব থাকা অসম্ভব কিছু নয়, কারন সেই সময়টা অতীতের আদিম সাম্যবাদী পর্যায়ের থেকে বেশিদূরের কিছু ছিলোনা যখন সম্পদের মালিকানা গোষ্ঠীবদ্ধভাবে নির্ধারিত হতো। কিন্তু তেমনটিও যদি হয়, তাহলে বলতে হয় তারা অনেকটা অতীতমুখীই ছিল, প্রগতিমুখী নয়, এবং এটা শুধুমাত্র একত্রিতভাবে সমানভাগে ভাগ করে নেয়ার যে কম্যুনিস্ট ধারনা শুধুমাত্র তাতেই বিশ্বাসী ছিল কিন্তু গোষ্ঠীবদ্ধ উৎপাদন নিয়ে তাদের কোনও চিন্তা ছিলোনা।

উক্ত পর্যায়ে এমন একটি উদ্যোগ সমাজকে এগিয়ে নিতে যেত না বরং পিছিয়েই নিয়ে যেত। কারন আদতে কম্যুনিজম(শ্রেণীহীন সমাজ) বলতে যা বুঝায় তা কখনও অতীতের ঐতিহাসিক পর্যায়গুলোর মডেল অনুসরণ করে গড়ে উঠতে পারবেনা। এটির জন্য দরকার উৎপাদন প্রণালীর উচ্চ বিকাশ, যাতে করে আবালবৃদ্ধবনিতা সবাই অতিরিক্ত শ্রমের বোঝা থেকে মুক্ত হয়ে নিজেদের পূর্ণ মানবিক বিকাশের সময় পায়। কিন্তু এই ধরনের কোনওকিছু করার জন্য স্পার্টাকাসের সমাজ বস্তুগত ভিত্তির দিক থেকে তৈরী ছিলোনা।

দাসশ্রেণী যদি বিজয় লাভ করতো তাহলে কী হতো? তারা যদি রোমান সাম্রাজ্যের পতন ঘটাতে সফল হতো তাহলে অবশ্যই সেটি ইতিহাসের গতিপথে একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড় হিসেবে স্থান পেত। তবে হুবহু কী ঘটতো সেটি বলা সম্ভব নয় অবশ্যই। হয়তো সকল দাসকে মুক্ত করে দেয়া হতো কিন্তু সেটিও নির্বিঘ্নে বলা যাচ্ছেনা। যদি সকল দাস মুক্ত হয়েও যেত, তারপরেও যে পরিমান বিকাশ উৎপাদন প্রণালীতে ততদিনে ঘটেছিল, তার ভিত্তিতে বলা যায় হয়তো সাধারণভাবে কোনও এক প্রকার সামন্ততন্ত্রের দিকেই প্রবাহিত হত সমাজ কাঠামো।

বেশ কয়েক শতাব্দী পর এই ঘটনাই ঘটেছিল রোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর। দাসভিত্তিক উৎপাদন ব্যবস্থা ও অর্থনীতি তার চরম সীমার গিয়ে পৌঁছানোর পর সংকটের মুখোমুখি হয়। দাসদের মুক্ত করে দেয়া হয়েছিল কিন্তু তারা বাঁধা পড়েছিল জমির সাথে সার্ফ হিসেবে। যদি এই রদবদল আরেকটু আগে হতো তাহলে হয়তো ইতিহাসের গতি বৃদ্ধি পেত, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক বিকাশ দ্রুত ঘটতো, হয়তো ইউরোপের ইতিহাসে অন্ধকার যুগ নামে কিছু থাকতোনা এবং তার ভয়ংকর পরিণতি থেকে রক্ষা পাওয়া যেত।

তবে যত যাই হোক এগুলো শুধুমাত্র জল্পনা কল্পনাই বটে। প্রকৃত ঘটনা এটাই যে দাসবিদ্রোহ সফল হয়নি এবং অনেকগুলো কারনেই তা হতে পারেনি। মার্ক্স এবং এঙ্গেলস তাদের কম্যুনিস্ট মেনিফেস্টোতে লিখেছিলেন যে, আজ পর্যন্ত যত সমাজ দেখা গিয়েছে তাদের সকলের ইতিহাসই শ্রেণীসংগ্রামের ইতিহাসঃ

স্বাধীন মানুষ দাস, প্যাট্রিশিয়ান এবং প্লিবিয়ান, জমিদার ভূমিদাস, গিল্ডকর্তা আর কারিগর, এক কথায় নিপীড়ক এবং নিপীড়িতরা সর্বদাই পরস্পরের প্রতিপক্ষ হয়ে থেকেছে, অবিরাম লড়াই চালিয়েছে, কখনও আড়ালে কখনও প্রকাশ্যে, প্রতিবার লড়াই শেষ হয়েছে গোটা সমাজের বৈপ্লবিক পরিবর্তনের মাধ্যমে অথবা দ্বন্দরত শ্রেণীর বিনাশের মাধ্যমে।

রোমান সম্রাজ্যের পরিণতি দ্বিতীয় কথাটির(দ্বন্দরত শ্রেণীর বিনাশ) একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে রয়েছে ইতিহাসে। স্পার্টাকাস বাহিনীর পরাজয়ের পিছনে মৌলিক কারনটি হচ্ছে তারা শহুরে শ্রমজীবীদের সাথে একাত্মতা পোষণ করেনি। সুতরাং শহুরে শ্রমজীবী শ্রেণীটি রাষ্ট্রীয় পক্ষেই রয়ে গিয়েছিল যার ফলে দাসশ্রেণীর জয়লাভও অনিশ্চিত হয়ে দাড়িয়েছিল। তবে রোমান শ্রমজীবী শ্রেণী আর আধুনিক শ্রমজীবী শ্রেণীর মধ্যে পার্থক্য রয়েছে, রোমান শ্রমজীবী বা রোমান প্রলেতেরিয়াতরা কোনও উৎপাদনশীল শ্রেণী ছিলোনা। তারা মূলত পরজীবী শ্রেণীই ছিল, তারা দাসশ্রেণীর শ্রম এবং মালিকশ্রেণীর করুণার উপর ভর করেই জীবনযাপন করতো।

উপরোক্ত কারনের মধ্যেই রোমান বিপ্লবের ব্যর্থতার মূল নিহিত। যার ফলাফল হয়েছিল রোমান রিপাবলিকের রদ। এবং অত্যাচারী নিপীড়ক সাম্রাজ্যের উত্থান যা পরবর্তীতে অনেকবছরের দুর্নীতি অবক্ষয়, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ব্যর্থতার পর শেষ পর্যন্ত হার মেনেছিলো বার্বারিয়ানদের হাতে।

সমাজের সবথেকে নিপীড়িত শ্রেণী একত্রে অস্ত্র তুলে নিয়ে একতাবদ্ধ হয়ে, তৎকালীন পৃথিবীর সর্বশক্তিধর সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে একের পর এক যুদ্ধ করে জয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল এটি ইতিহাসের চিত্রপটে একটি মনোরম দৃশ্যই বটে। শেষ পর্যন্ত স্পার্টাকাস পরাজয় বরণ করেছিল। হয়তো এমনটিই হওয়ার কথা ছিল এই বিদ্রোহের ক্ষেত্রে। কিন্তু এই বিদ্রোহ ইতিহাসের একটি মহিমান্বিত ঘটনা হিসেবে লিপিবদ্ধ হয়ে রয়েছে যা কখনোই মুছে যাবেনা, শুধু তাই নয়, এই ঘটনা যেমন ইতিহাসের স্বর্ণাক্ষরে লিখিত রয়েছে, তেমনি এই ঘটনা মানব ইতিহাসের পরবর্তী প্রজন্মের বিদ্রোহী, বিপ্লবীদের জন্যও অনুপ্রেরণাদায়ক ঘটনা হিসেবে কাজ করেছে এবং করবে। যারা সত্য এবং ন্যায়ের পক্ষে লড়াকু সৈনিক তাদের জন্য বারবারই স্পার্টাকাসের বীরত্বের কাহিনী প্রেরণা দেয়। এই অতিকায় বিদ্রোহের প্রতিধ্বনি ততবারই ইতিহাসে শোনা যাবে যতবার মানুষ একত্রিত হয়ে একটি উত্তম পৃথিবীর জন্য সংগ্রাম চালিয়ে যাবে।

রচনার মূলসূত্র।