ডেভিড হার্ভে একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং একজন ভূগোলবিদ যিনি নিজেকে মার্ক্সবাদী বলে অভিহিত করেন। ২০০৮ সালের মন্দার বদৌলতে বিশাল সংখ্যক তরুণপ্রজন্ম মার্ক্সবাদের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠে, যার ফলে তার ভিডিও লেকচার “ক্যাপিটাল” সিরিজও জনপ্রিয়তা পায় এবং লাখ লাখ ভিউ লাভ করে। এসব কারনে, সাম্প্রতিক সময়ে দেয়া তার বিবৃতি, যেখানে তিনি বিপ্লবী পদ্ধতিতে পুঁজিবাদ উৎখাত করার বিরুদ্ধে মতামত দিয়েছেন, সেটি যৌক্তিকভাবেই একধরনের উত্তেজনাপূর্ণ বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।
হার্ভের চিন্তাভাবনা সম্পর্কে অনেক ধরনের সমালোচনামূলক বক্তব্যই দেয়া যায়। যেমন, তাত্ত্বিক এবং প্রায়োগিক উভয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই তার ‘accumulation by dispossesion’ তত্ত্বের কিছু ত্রুটি রয়েছে। ‘ক্যাপিটাল’ নিয়ে তার যে লেকচার সিরিজ, তা প্রাথমিক পাঠ হিসেবে খুবই উপযুক্ত, কিন্তু সেগুলোর মধ্যেও কিছু গুরুতর ত্রুটি রয়েছে। তবে এই প্রবন্ধে আমি শুধুমাত্র সাম্প্রতিক সময়ে বিপ্লবের বিরুদ্ধে তার যে বিবৃতি, তা নিয়েই আলোচনা করবো, কারন আমার মনে হয় এই বিষয়ে তিনি যথাযথ পরিষ্কার বক্তব্য দিতে পারেননি, এবং এছাড়াও তার এই বক্তব্য আরও একটি সমস্যার লক্ষণ যা প্রায় সময়েই একাডেমিক এবং সংস্কারপন্থীদের মধ্যে দেখা যায়।
সংস্কারপন্থী হার্ভে
মার্ক্সবাদ শুধুমাত্র একাডেমিক মহলে সীমাবদ্ধ বিষয় কিংবা শুধুমাত্র বিশ্লেষণের পদ্ধতি নয়। মার্ক্স দুনিয়া বদলানোর জন্যই তার বোঝাপড়া এবং বিশ্লেষণ করেছিলেন, যেমনটি তিনি ‘থিসিস অন ফয়েরবাখ’ এ খুব পরিষ্কারভাবেই ঘোষণা দিয়েছিলেন। মার্ক্সের ক্ষেত্রে, বিপ্লবী চর্চা কোনও ঐচ্ছিক অতিরিক্ত বিষয় নয় বরং তার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের একটি কেন্দ্রবিন্দু, তার বিশ্লেষণের ফলাফল এবং কারন। ভায়দেমায়ারকে এক চিঠিতে তিনি লিখেছিলেনঃ
“আমার কাছে মনে হয়, আধুনিক সমাজের অস্তিত্বমান শ্রেণীসমূহ অথবা তাদের মধ্যে বিদ্যমান দ্বন্দ আবিষ্কারের ক্ষেত্রে আমার নিজস্ব কোনও কৃতিত্ব নেই। আমার বহু আগেই বুর্জোয়া ইতিহাসবিদেরা এই শ্রেণীদ্বন্দের ঐতিহাসিক বিকাশকে চিহ্নিত করেছিলেন এবং বুর্জোয়া অর্থনীতিবিদেরাও অর্থনৈতিক শ্রেণীর বিশ্লেষণ করেছিলেন। আমি যে নতুন আবিষ্কারগুলো করেছি তা হচ্ছেঃ (১) শ্রেণীসমূহের অস্তিত্ব ব্যাপারটি ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে উৎপাদনের বিকাশের সাথে সম্পর্কিত(historische Entwicklungsphasen der Production), (২) শ্রেণী দ্বন্দের বিষয়টি অবধারিতভাবেই প্রলেতেরিয়াতের একনায়কতন্ত্রের দিকে পরিচালিত হয়, (৩) এই একনায়কতন্ত্র শুধুমাত্র সকল ধরনের শ্রেণীর বিনাশ এবং একটি শ্রেণীহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে রূপান্তরকারীর ভূমিকা পালন করে থাকে।” (জে. ভায়দেমেয়ারকে মার্ক্স, নিউ ইয়র্ক, ৫ই মার্চ, ১৮৫২)
তাহলে, হার্ভে বিপ্লব সম্পর্কে কী বলেছিলেন এবং কোন প্রসঙ্গে বলেছিলেন? উক্ত বিবৃতগুলো ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে তার “Anti-Capitalist chronicles” এর একটি পর্বে করেছিলেন যেটির নাম ছিলো “Global Unrest”, যেখানে তৎকালীন সময়ে ইকুয়েডর, চিলি, লেবানন ইত্যাদি স্থানে চলমান বিদ্রোহগুলো নিয়ে আলাপ করা হচ্ছিলো। পুরো ভিডিওটি এবং হার্ভের বক্তব্যের ট্রান্সক্রিস্পটটিও অনলাইনে রয়েছে,সোসাল মিডিয়ায় বিদ্যমান খন্ড বক্তব্য দেখার থেকে এখান থেকে পুরো আলাপটি দেখে নেয়াই উত্তম। আমি এখানে বিস্তারিত আকারেই তার বক্তব্যগুলো উক্তি আকারে তুলে ধরবো, যাতে করে তার দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে কোনও ধরনের বিকৃতি কিংবা ভুলব্যাখার সম্ভাবনা এড়ানো যায়।
তার বক্তব্যের দুইটি মৌলিক ভিত্তি রয়েছে যেগুলো সঠিক এবং আমরা সেগুলোয় একমত হতে পারি। প্রথমত, সেই সময়ে আমরা পৃথিবীব্যাপী একধরনের আন্দোলন ও প্রতিবাদের বিস্ফোরণ লক্ষ্য করছিলাম। “ বর্তমান পরিস্থিতি দেখলে আপনি স্বভাবতই মনে করবেন, এসব প্রতিবাদের ধরনগুলো দেখে বুঝাই যায় বৈশ্বিকভাবে বিভিন্ন ধরনের গণআন্দোলন গড়ে উঠেছে।” যদিও তার বক্তব্যের সাথে এখানে আমি একটু দ্বিমত করে এসব আন্দোলনকে শুধুমাত্র প্রতিবাদ নয়, বরং “এসব আন্দোলনে একধরনের বিদ্রোহী বৈশিষ্ট্যও ছিল” বলে দাবী করতাম, তবে আপাতত এক্ষেত্রে একমত হওয়া নিশ্চিত যে এই আন্দোলনগুলো বিভিন্ন দেশের কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। হার্ভে চিলির আন্দোলন দিয়ে তার আলাপ শুরু করেন, তারপর তিনি ২০১৯ এর অক্টোবরে ঘটা ইকুয়েডের আন্দোলন, এবং তারপর লেবানন, ইরাক ও ফ্রান্সের ইয়েলো ভেস্ট আন্দোলন নিয়ে বক্তব্য রাখেন।
খুবই উদ্ভটভাবে, তিনি বলিভিয়ার ক্যু এর ঘটনাটিও এসব আন্দোলনের তালিকায় যুক্ত করেনঃ
“একই সাথে, কিছুটা ভিন্ন ধরনের আন্দোলন লক্ষ্য করবেন বলিভিয়াতে। সেখানে একটি নির্বাচন হয়েছিলো। সেটি নিয়ে অনেকেই সন্দেহ প্রকাশ করছিলো যে প্রেসিডেন্ট মোরালেস যতগুলো ভোট পেয়েছে বলে দাবী করছে আদতে তত ভোট পায়নি। পরবর্তীতে আমরা যা দেখতে পাই সেখানে, তাকে একধরনের ডানপন্থী গণবিক্ষোভ বলতে পারি। যার ফলশ্রুতিতে মূলত প্রেসিডেন্ট এবং তার সরকারী কর্মকর্তারা দেশত্যাগ করতে বাধ্য হয় এবং মেক্সিকোতে রাজনৈতিক আশ্রয় নেন। পরবর্তীতে আমরা আবার সেই রাজপথের গণ আন্দোলন এবং বিরোধী দলগুলোর মধ্যে বিভিন্ন হাঙ্গামা দেখতে পেয়েছিলাম”
সুতরাং, তিনি উক্ত আন্দোলনকে “ভিন্ন ধরনের আন্দোলন” আখ্যা দেন এবং তার পাশাপাশি “ডানপন্থীদের গণবিক্ষোভ” বলে দাবী করেছিলেন। তবে এই দুইটি ক্ষেত্রেই তিনি মূল ব্যাপারটি ধরতে ব্যর্থ হয়েছিলেনঃ ইভো মোরালেসের সরকার উৎখাত হয়েছিলো একটি ক্যুয়ের মাধ্যমে, যেখানে মিলিটারি প্রকাশ্যে বের হয়ে এসে টেলিভিশনে ইভো মোরালেসের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল এবং আল্টিমেটাম দিয়েছিল। এটি কোনও মামুলি বিষয় নয় এবং একজন মার্ক্সবাদী আবশ্যিকভাবেই বিপ্লবী বৈশিষ্ট্যপূর্ণ আন্দোলনের সাথে কোনও প্রতি-বিপ্লবী আন্দোলনকে একই কাতারে মাপবে না, বিশ্লেষণ করবে না, যাতে করে মনে হয় যে দুইটি ভিন্ন ধরনের আন্দোলনই মূলত একই কারনে ঘটছে।
তবে আপাতত এই আলাপ থেকে সামনে আগানো যাক। হার্ভের বক্তব্যের দ্বিতীয় যে ভিত্তিটির সাথে আমরা একমত হতে পারি সেটি হচ্ছে যখন তিনি বলেন, মূল সমস্যা নিওলিবারেলিজম নয় বরং ক্যাপিটালিজম নিজেইঃ
“এই অর্থনৈতিক ব্যাপারটিকে মূলত দুইটি পদ্ধতিতে আপনি ভাবতে পারেন। প্রথমে বলতে গেলে, বর্তমান যে নিদির্ষ্ট ফর্মে পুঁজি সঞ্চয় ঘটে সেটির সমস্যা রয়েছে, যেটি পুঁজিবাদের একটি নিদির্ষ্ট ফর্ম, যেটিকে আমরা সাধারণভাবে নিওলিবারেলিজম বলে থাকি, অর্থাৎ সমস্যা পুঁজিবাদের নয় বরং পুঁজিবাদের নিওলিবারেল ফর্মে... এভাবে দেখা যায় বিষয়টিকে, কিন্তু আমি এভাবে দেখিনা। বরং আমি বলবো, অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, অর্থনৈতিক মডেল, এগুলো আর কাজ করছে না, এবং এই অকার্যকর মডেলটির নামই পুঁজিবাদ। সুতরাং আমি এটা দাবী করবো যে, এটি খুবই বাস্তব এবং গুরুতর একটি প্রশ্ন। এবং আমরা সবাইই এই বিষয়টি নিয়ে সচেতন হচ্ছি।”
এ পর্যন্ত সব ঠিকঠাকই আছে।
তিনি প্রথমে পুঁজিবাদ নিজেই যে সমস্যা এই ব্যাপারটিকে চিহ্নিত করেন এবং বিশ্বব্যাপী চলমান আন্দোলনগুলোর পেছনে এটাই যে কারন সেটি দাবী করেন, কিন্তু এরপর তিনি তার নিজের দাবীরই বিপরীত একটি প্রস্তাবনা দাঁড় করান, তিনি বলেন পুঁজিবাদকে সরাসরি উৎখাত করার যেসব ধারনা সেগুলো সম্পর্কে আমাদের সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। এই ব্যাপারে পরবর্তীতে তিনি যে কারনগুলো দেখান সেগুলো একেবারেই অবান্তর, অবাস্তব এবং অসত্য।
চলুন সেগুলো দেখা যাকঃ
"আরেকটি সমস্যার দিক হচ্ছেঃ মার্ক্সের যুগে যদি পুঁজিবাদের আকস্মিক পতন ঘটলেও বিশ্বের বেশিরভাগ মানুষ নিজেদের আহার যোগাড় করতে পারতো এবং পুনউৎপাদন জারি রাখতে পারতো। কারন বেশিরভাগ মানুষই তখন তাদের আঞ্চলিক এলাকার উপর ভিত্তি করে নিজেদের উৎপাদন প্রক্রিয়া জারি রাখার মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহের মত স্ব-নির্ভরশীল ছিলো, অর্থাৎ, বৈশ্বিক অর্থনীতিতে কী হচ্ছে না হচ্ছে সেগুলো একপাশে রেখেও মানুষ সকালবেলা তাদের খাবার টেবিলে খাবারের যোগান দিতে সক্ষম ছিল। বর্তমানে সেরকম পরিস্থিতি আর নেই। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ এবং জাপানে বেশিরভাগ মানুষই সম্পূর্ণভাবে তাদের খাদ্য সরবারহ সিস্টেমের উপর নির্ভরশীল, এমনকি বর্তমানে ভারত, চীন ও ইন্দোনেশিয়া সহ সর্বত্রই এই নির্ভরশীলতা বৃদ্ধি পেয়েছে যার ফলে তাদের খাদ্যের সরবারহ পুঁজির সঞ্চলনের উপর নির্ভর করে। আমার মতে, মার্ক্সের যুগে এই ব্যাপারটি হতো না, কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে সম্ভবত বিশ্বের প্রায় ৭০ অথবা ৮০ ভাগ মানুষের খাদ্য সরবারহ পুঁজির সঞ্চলনের উপর নির্ভর করে, সেই সরবারহ প্রক্রিয়ার সক্রিয়তা নির্ভর করে আবার জ্বালানি শক্তির উপর, যার ভিত্তিতে নির্ধারিত হয় তারা সরবারহ ঠিকভাবে পাচ্ছে কিনা এবং জীবনের পুনউৎপাদন প্রক্রিয়া বজায় রাখতে পারছে কিনা।
এটি বিপ্লবের বিরুদ্ধে বেশ আজগুবি একটি যুক্তি যার কোনও বাস্তব ভিত্তিই নেই! অনেক দিক থেকেই এই যুক্তি ভুল, সমস্যাজনক। প্রথমত, মার্ক্সের যুগেও, মজদুররা পুঁজিবাদী বাজার দ্বারাই তাদের জীবিকা নির্বাহ করতো। তারা বেতনের জন্য কাজ করতো এবং সেই বেতন দিয়ে বাজার থেকেই খাদ্য ক্রয় করতো। ঠিক এখনকার মতই। ১৮৫০এর দিকে হয়তো কিছু শ্রমিক ছিল যাদের বাড়ির পেছনে কিছু টুকরো জমিতে তারা বাগান করতো (তবে সে যুগেও বড় বড় শিল্পএলাকাগুলোতে গড়ে ওঠা বস্তিবাসী শ্রমিকশ্রেণীর সে ব্যবস্থা ছিলোনা অবশ্যই), কিন্তু সেটাই একমাত্র কোনও শর্ত নয় যা সে যুগে বিপ্লবকে সম্ভবপর করে তুলতো। উপরে বর্ণিত তথ্যটি, "বর্তমান পরিস্থিতিতে সম্ভবত বিশ্বের প্রায় ৭০ অথবা ৮০ ভাগ মানুষের খাদ্য সরবারহ ও জীবিকা নির্বাহ পুঁজির সঞ্চলনের উপর নির্ভর করে" এই ব্যাপারটি বরং বিপ্লবের সম্ভাবনার জন্য একটি ইতিবাচক দিকই বটে! অর্থাৎ, বৈশ্বিকভাবে কৃষক সম্প্রদায় এতটাই কোণঠাসা হয়ে পড়েছে যে কৃষিখাতও বড় বড় পুঁজিবাদী ফার্মিং এর তত্ত্বাবধানে চলে গিয়েছে। এর মানে দাড়ায় সমাজে শ্রমজীবী শ্রেণীর সংখ্যাটি ভারিক্কির দিক দিয়ে অতীতের যেকোনও সময়ের তুলনায় এখন সর্বোচ্চ। মার্ক্সের ব্যাখ্যায় আমরা দেখতে পাই, পুঁজিবাদের অধীনে শ্রমজীবী শ্রেণীই একমাত্র বিপ্লবী শ্রেণী। এই শ্রেণী সংখ্যায় যত ভারী হবে এবং শক্তিশালী হয়ে উঠতে থাকবে, সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের সম্ভাবনাও তত বাড়তে থাকবে, যে বিষয়টি সম্পর্কে হার্ভে একেবারেই অসচেতন।
এছাড়াও, “পুঁজিবাদের আকস্মাৎ পতন” এর ফলে হার্ভের দৃষ্টিতে সকল উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাবে, এটির সাথে বিপ্লবের কোনও সম্পর্ক নেই। একটি সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের সময় শ্রমিকেরা রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করে এবং উৎপাদন প্রণালীগুলোর মালিকানা নিয়ে সেগুলো নিয়ন্ত্রন করতে সক্ষম হয়। পরবর্তীতে শ্রমিকরা নিজেরাই সমাজের প্রয়োজনে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে উৎপাদনব্যবস্থার পরিকল্পনা করে থাকে।
পুঁজিবাদঃ পতন অসম্ভব?
বিপ্লবের সাথে উৎপাদন প্রক্রিয়া আকস্মাৎ বন্ধ হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটিকে সমানভাবে দেখেন হার্ভে, যার ফলে তার মতে এটি একটি বিপর্যয়ঃ
"সুতরাং আমার মনে হয় এই পরিস্থিতিকে আমি সংক্ষিপ্ত আকারে অনেকটা এভাবে বলতে পারি যে, পুঁজি এখন এতই বিশাল আকার ধারন করেছে এটির পতন অসম্ভব। আমরা এখন আর এমন কোনও পরিস্থিতি কল্পনা করতে পারিনা যেখানে আমরা পুঁজির সঞ্চলন বন্ধ করে দিতে সক্ষম হব, কারন সেটি করলে বিশ্বের ৮০ভাগ মানুষ অনাহারে পতিত হবে, যোগাযোগহীন হয়ে পড়বে এবং পুনরুৎপাদনের মাধ্যমে তাদের জীবিকা নির্বাহ করতে পারবেনা ঠিকভাবে।"
শ্রমজীবী শ্রেণীর সৃজনশীল শক্তিকে অনুধাবন করতে একাডেমিকরা যে অক্ষম তার একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত এটি। গত ১০০ বছরে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন আন্দোলনের দিকে চোখ বুলালেও এটা পরিষ্কারভাবে বোঝা যায় যে হার্ভের বক্তব্য ভুল। যেকোনও বিপ্লবী আন্দোলনের বিকাশের সময়েই এটা লক্ষনীয় যে শ্রমজীবী শ্রেণী কারখানা, খাদ্য উৎপাদন ইত্যাদি প্রক্রিয়ার দখল নিতে সক্ষম। ১৯৭১-৭৩ সালে চলমান চিলি বিপ্লবের সময় যখন একদল প্রতিক্রিয়াশীল ট্রাক-মালিকদের অবরোধের মুখে পড়েছিলো শ্রমজীবী শ্রেণী, তখন তারা নিজেদের মত করে পিপল'স প্রভিশনিং কমিটি (Peoples’ Provisioning Committees) গঠন করেছিল যাতে করে খাদ্যের সরবরাহ জারি থাকে। স্প্যানিশ বিপ্লবের সময় যখন ফ্যাশিস্টরা লেজ গুটিয়ে পালিয়েছিল তাদের শিবিরে, তখন শ্রমজীবী শ্রেণীর সংগঠনগুলো চলমান কারখানাগুলোর দখল নেয়, জমির ভাগবাটোয়ারা করতে সক্ষম হয় এবং খাদ্য বন্টনের ব্যাপারটিও নিশ্চিত করেছিল। ফ্রান্সে ১৯৬৮ সালে মে বিপ্লবের সময়ও ১০ মিলিয়ন শ্রমিক একসাথে ধর্মঘট শুরু করেছিল, কারখানার দখল নিয়েছিল এবং চাষাবাদী শ্রমিকেরা শহরের বিভিন্ন এলাকায় প্রভিশনাল শ্রমিক কমিটি গঠনের মাধ্যমে শহর দখল করেছিল। ২০০২-০৩ সালে ভেনেজুয়েলাতে যখন মালিকশ্রেণী তেল কোম্পানির অবরোধ করেছিলো, তখন শ্রমিক শ্রেণীই সংগঠির হয়ে সেসব কোম্পানির দখল নিয়ে সেগুলোকে নিজেদের নিয়ন্ত্রনে পুনরায় চালু করেছিল। এগুলো সবই মূলত শ্রমজীবী শ্রেণীর সাংগঠনিক শক্তির বহিঃপ্রকাশ যা সমাজকে আগাগোড়া বদলে দিতে সক্ষম।
সুতরাং হার্ভে কী বলতে চাচ্ছে সেটি নিয়ে আর সন্দেহ থাকেনা। তার মতে, পুঁজিবাদের ধ্বংস এবং নতুন সমাজ গঠন একটি প্রাচীন যুগের রূপকথাঃ
"সুতরাং পুঁজির সঞ্চলনের উপর কোনও দীর্ঘস্থায়ী আক্রমণ করার সামর্থ্য আমাদের নেই। অতএব, ১৮৫০ এর আমলে যে ধরনের ভাবনা সমাজতান্ত্রিক বা কম্যুনিস্টদের ছিল যে পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকে ভেঙে দিয়ে নতুন কোনও সমাজ গঠন করা সম্ভব, সেটি বর্তমানে আসলে অসম্ভবই বটে। আমাদেরকে পুঁজির সঞ্চলন জারি রাখতে হবে, চলমান ব্যবস্থাকেই গতিশীল রাখতে হবে, কারন আমরা যদি তেমনটা না করি, তাহলে হয়তো আমরা এমন কোনও পরিস্থিতিতে আটকে যাব, যেখানে আমাদের সবাইকেই অনাহারে ভুগতে হবে।"
এইযে এখানেই আপনারা দেখতে পাচ্ছেন। তিনি স্বীকার করে নিচ্ছেন যে, পুঁজিবাদ আর ঠিকভাবে কাজ করছেনা, আবার একইসাথে তিনি বলছেন যে, এটার ধ্বংসও সম্ভব না। মোটের উপর এটাই আসলে একাডেমিক মার্ক্সবাদের নপুংসকতা। অবশ্য হার্ভে অন্তত তার নিজের বিশ্লেষণের ভিত্তিতে উপসংহার টানার মত সৎ বটে। যদি পুঁজিবাদ ধ্বংসই করা না যায়, তাহলে বামপন্থীরা মোটের উপর এটিকে সংস্কারের চেষ্টা করতে পারেঃ
"এবং এর মানে হচ্ছে পুঁজিবাদ এতই বৃহদাকৃতির যে এটির পতন অসম্ভব। এটি অতিরিক্ত শক্তিশালী এবং আমাদেরও উচিত এটির পতন ঠেকানো। আমাদেরকে কিছু সময় নিতে হবে, এটিকে আরও উন্নত করতে হবে, পুনর্গঠনের চেষ্টা করতে হবে, এবং হয়তো মাঝেমাঝে বিভিন্ন পরিবর্তন ঘটিয়ে এটিকে একটি ভিন্ন আকৃতি নিতে হবে। কিন্তু বিপ্লবী পদ্ধতিতে পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার উৎখাত বর্তমান সময়ে একেবারেই কাম্য নয়। এর পতন হবেনা, এবং হতে পারেওনা, এবং আমাদেরকেই নিশ্চিত করতে হবে যাতে এর পতন না হয়।"
পুঁজিবাদের সমালোচক হিসেবে হার্ভে মন্দ নয়, তিনি পুঁজিবাদের সমালোচনা করে অনেক লেখালেখি করেছেন, অনেক লেকচার দিয়েছেন, সেসবে ব্যাখ্যা করেছেন কেন পুঁজিবাদ শোষণমূলক ব্যবস্থা এবং সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠের জন্য ক্ষতিকারক। কিন্তু দিনশেষে তিনি পুঁজিবাদের বিপ্লবী উৎখাতের বিরুদ্ধেই দাড়িয়েছেন এবং যুক্তি দিচ্ছেন যে, পুঁজিবাদকে আরেকটু উন্নত(!) করতে হবে আমাদের (আমার মনে হয় তিনি এখানে "আমাদের" বলতে বামপন্থীদের এবং শ্রমিকদের আন্দোলনকেই বুঝাচ্ছেন), এবং পুঁজিবাদকে ধীরে ধীরে উন্নত করে এটিকে "ভিন্ন আকৃতি" দিতে হবে।
তার অবস্থান পুরোপুরিভাবে সংস্কারপন্থী এটি তার বক্তব্যের উপসংহারের দিকে তাকাইলে বোঝা যায়ঃ
"অতএব আমার মতে, সমাজতান্ত্রিক কার্যক্রম অথবা এন্টি-ক্যাপিটালিস্ট কার্যক্রম বলতে আমাদের উচিত এমনভাবে কাজ করা, যাতে করে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা আরেকটু মানবিক হয়ে ওঠে, অস্তিত্ব রক্ষার যে রাক্ষুসে লড়াই তা থেকে বের হয়ে আসতে পারে এবং পাশাপাশি এটিকে এমনভাবে পুনর্গঠন করা উচিত যাতে করে মুনাফা নির্ভর হয়ে থাকার বৈশিষ্ট্য থেকে পুঁজিবাদ বের হয়ে আসতে পারে। বিশ্বের মানুষের কাছে ব্যবহারিক মূল্য ব্যাপারটিকে সুলভ করে তুলতে পারে, যাতে করে সবাই শান্তিতে পুনরুৎপাদন প্রক্রিয়া বজায় রাখতে পারে। যাতে করে বর্তমানের মত অশান্তিপূর্ণ অবস্থা না হয় এবং এই অশান্তির যুগকে অতিক্রম করে শান্তির যুগে পদার্পণ করা যায়।"
সুতরাং বুঝাই যাচ্ছে, হার্ভে একধরনের কাল্পনিক ধারনা লালন করে যে পুঁজিবাদকে সংস্কার করা সম্ভব, সংস্কার করে এমন একটি ব্যবস্থায় রূপান্তর করা সম্ভব যেখানে পুঁজিবাদ মুনাফা নির্ভর হয়ে চলবেনা বরং বিশ্বমানবতাকে ব্যবহারিক মূল্য উপহার দিবে (!) এটা এখন পরিষ্কার যে, হার্ভে কার্ল মার্ক্সের পুঁজি গ্রন্থ পাঠ করে হয়তো কিছুই শেখেনি এবং পুঁজিবাদকে বোঝার ক্ষেত্রে তার পদ্ধতি মার্ক্সবাদীও নয়, শ্রেণী সংগ্রামের ধারনাটিকেও তিনি অবহেলা করেন। মূলত পুঁজিবাদ টিকেই থাকে প্রতিনিয়ত নিরবিচ্ছিন্ন মুনাফা লাভের প্রচেষ্টার উপর। পুঁজিবাদীরা মোটেও ব্যবহারিক মূল্য উৎপাদনে আগ্রহী নয়, বরং তারা বিনিময় মূল্যকেই প্রাধান্য দেয় যাতে করে তারা মুনাফার প্রবাহ জারি রাখতে পারে এবং এর মাধ্যমে পুঁজির পুনরুৎপাদনের মাত্রা বৃদ্ধি করতে পারে। পুঁজিবাদকে "বাগে এনে" এমন কোনওকিছুতে পরিণত করা সম্ভব না যা একেবারেই এর ভিত্তির বিপরীত, যেমন করে আপনি কোনও মাংশাসী প্রাণীকে বাগে এনে নিরামিষভোজীতে পরিণত করতে পারবেন না, বরং তা করতে গেলে আপনার নিজেরই এর খাদ্যে পরিণত হবার সম্ভাবনা রয়েছে। শাসকশ্রেণীর প্রস্তাবিত "স্টেকহোল্ডার পুঁজিবাদ" এর ব্যবস্থাকে একেবারে ঠিকভাবেই সমালোচনা করেছিলেন হার্ভে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি নিজেও তেমন একটা কিছুরই প্রস্তাব করছেন।
তার থেকেও জঘন্য অবশ্য এটা যে, তিনি আবার এরপর দাবী করছেন এখনকার "অশান্তিপূর্ণ সময়ের" বদলে এই ধরনের ব্যবস্থা বিশ্বে "শান্তি ও স্থিরাবস্থা" আনতে সক্ষম হবে। তিনি শুধুমাত্র বিপ্লবের সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি, বরং তার কাছে চিলি এবং ইকুয়েডরের মত বিপ্লবী আন্দোলনগুলোকে বিরক্তিকর "অশান্তিপূর্ণ সময়" মনে হয়েছে যা "শান্তি এবং স্থিরাবস্থা"কে ব্যহত করছে।
আমার জানা মতে এর পূর্বে কখনও ডেভিড হার্ভে তার নিজের অবস্থানকে এত পরিষ্কারভাবে বিপ্লব বিরোধী অবস্থান হিসেবে ব্যাখ্যা করেন নি। যদিও তিনি যেসব আলাপ সালাপ করেছেন সেগুলো আকাশ থেকে পড়েনি, বরং এগুলো তার নিজের বিশ্লেষনেরই ফলাফল। লিও পানিচের সাথে একটি সাক্ষাৎকারে তিনি “Impossible Reform and Improbable Revolution” শিরোনামে আলাপ করেছিলেন। এখন তিনি মূলত একজন বিপ্লব বিরোধী সংস্কারপন্থী হিসেবেই আত্মপ্রকাশ করেছেন।
"চিরায়ত শ্রমজীবী শ্রেণী'র আর অস্তিত্ব নেই" অথবা "নিওলিবারেলিজম আমাদের মানসপট গ্রাস করেছে" এই ধরনের চিন্তাভাবনার উপর ভিত্তি করে তিনি বিশ্লেষণ করেন, এবং ফলশ্রুতিতে তিনি বর্তমান সময়ে আমাদের চোখের সামনে কী ঘটে যাচ্ছে তার সম্পূর্ণ নির্যাস উপলব্ধি করতে অক্ষম। ২০১৯ এর অক্টোবর-নভেম্বরে ঘটে যাওয়া চিলি এবং ইকুয়েডেরের আন্দোলনগুলো আমাদেরকে দুইটি বিষয় দেখিয়ে দিয়েছিল, একদিকে পুঁজিবাদের সংকট এবং মৌলিক চাহিদা মিটানোর ক্ষেত্রে এর অক্ষমতা; অন্যদিকে, শ্রমজীবী মানুষ একত্রিত হয়ে যখন আন্দোলন শুরু করে, তার একটি বিশাল শক্তি সঞ্চারন ঘটে। দুইটি ঘটনাতেই, বিদ্রোহী বৈশিষ্ট্যপূর্ণ বিশাল আন্দোলনের মুখোমুখি হয় শাসকশ্রেণী এবং অন্তত ভ্রুণরূপে হলেও, এই আন্দোলনের ফলে আরও একবার শাসক-শাসিতের দ্বৈত ক্ষমতার দ্বৈরথ সমর ঘটে। ইকুয়েডরের পিপল'স এসেম্বলি এন্ড ইন্ডিজেনার গার্ড, চিলির কাবিলদোস আবিয়ের্তোস(mass neighbourhood assemblies), পিপল'স এসেম্বলিস এবং প্রাইমেরা লিনিয়া ডিফেন্স কমিটি, এইসব সংগঠনই মূলত ছিল শ্রমজীবী শ্রেণী'র ক্ষমতার প্রাথমিক চেহারা, নতুন ধরনের প্রতিষ্ঠান এবং নতুন সমাজ গঠনের ভিত্তি ও পূর্বাভাস।
এটা সত্য যে ওইসব আন্দোলনগুলো জয়লাভ করতে পারেনি। শ্রমজীবী শ্রেণী ক্ষমতায় বসতে পারেনি। পুঁজিবাদ সফলভাবে উৎখাত হয়নি। তবে এগুলো কোনওটিই ডেভিড হার্ভের ব্যাখ্যাকৃত কোনও কারনবশত নয়। "পুঁজিবাদ এতই বিশাল যে এর পতন সম্ভব না. অথবা "বিপ্লব অসম্ভব" এমন কোনও কারনে আন্দোলনগুলো সফলতা পায়নি তেমন নয় ব্যাপারটি। বরং একধরনের মার্ক্সবাদী নেতৃত্ব যা আন্দোলনগুলোকে জয়লাভের দিকে পরিচালিত করতে পারে সেই ব্যাপারটির অভাব ছিল। যেই নেতৃত্ব গড়ে তোলা বাকি এখনও ইকুয়েডর, চিলি এবং আরও অন্যান্য স্থানে। এই নেতৃত্ব গড়ে উঠবে মার্ক্স এবং অন্যান্য মার্ক্সবাদীদের চিন্তাভাবনা পাঠ করে এবং তা বোঝাপড়ার মাধ্যমে। তবে সেই কাজে ডেভিড হার্ভের সংস্কারপন্থী, পরাজয়মূলক, নীতিভ্রষ্ট একাডেমিক নপুংসকতা কোনও সাহায্য করতে পারবেনা দুর্ভাগ্যজনকভাবে।
একজন ‘একাডেমিক মার্ক্সবাদী’ হিসেবে আপনি কখনও মার্ক্সবাদী হতে পারেন না
Jacobin ম্যাগাজিনের একটি সাক্ষাৎকারে যখন ডেভিড হার্ভেকে সরাসরি প্রশ্ন করা হয়েছিলো সে মার্ক্সবাদী কিনা, তার উত্তরে তিনি বলেছিলেনঃ
"আমি একবার আমার কিছু স্নাতক শ্রেণীর ছাত্রছাত্রীদেরকে বলেছিলাম আমাদের মার্ক্স পড়া উচিত। তো সেই সূত্রেই আমি মার্ক্স পড়া শুরু করি, এবং আমার কাছে তাকে খুব প্রাসঙ্গিক মনে হতে থাকে। এক অর্থে এটাকে অনেকটা বুদ্ধিবৃত্তিক চয়েজই ছিল, রাজনৈতিক নয়। কিন্তু পরবর্তীতে আমি যখন আমার কিছু কাজে মার্ক্সকে ইতিবাচকভাবে উদ্ধৃত করতে লাগলাম, মানুষজন আমাকে এরপর থেকেই মার্ক্সবাদী বলে দাবি করতে লাগলো। আমি জানতাম না এটার অর্থ কী আসলে, কিন্তু কিছুদিন পরে আমি এটা অস্বীকার করা থামিয়ে দিলাম এবং ভাবলাম, 'ঠিক আছে, যদি আমি মার্ক্সবাদী হয়ে থাকি, তবে হলাম মার্ক্সবাদী, যদিও আমি জানতাম এটার অর্থ কী'- এবং আমি আসলে এখনও জানিনা এটার মানে কী দাড়ায়। এটার হয়তো কোনও পরিষ্কার রাজনৈতিক বার্তাও রয়েছে পুঁজিবাদের সমালোচক হিসেবে।"
এই বক্তব্য খুবই গোলমেলে, কিন্তু এটা মার্ক্সবাদ নয়। মার্ক্সবাদ শুধুমাত্র পুঁজি এবং পুঁজিবাদের সমালোচনা হয়, মার্ক্সবাদ হচ্ছে পুঁজিবাদকে উৎখাত করার একটি বিপ্লবী তত্ত্ব।
যেমনটা লেনিন তার রাষ্ট্র এবং বিপ্লব বইতে বলেছিলেনঃ
"বর্তমান সময়ে মার্ক্সের তত্ত্বের সাথে যা ঘটে চলছে, ইতিহাসের বিভিন্ন যুগে নিপীড়িত শ্রেণীর জন্য মুক্তিসংগ্রামরত অন্যান্য চিন্তানায়ক ও নেতাদের মতবাদের ক্ষেত্রেও তাই ঘটতে দেখা গিয়েছে। মহান বিপ্লবীদের জীবদ্দশায় শাসকশ্রেণী নির্মমভাবে তাদেরকে নির্যাতন করে, তাদের তত্ত্বের প্রতি বিদ্বেষপূর্ণ বৈরিতা ও হিংস্র ঘেন্না প্রকাশ করে এবং নির্বিচারে তাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা ও কুৎসা রটায়। মৃত্যুর পরে এইসব বিপ্লবীকে নিরীহ দেবদূতে পরিণত করা, সাধু সিদ্ধ পুরুষরূপে গণ্য করার চেষ্টা হয়ে থাকে; নিপীড়িত শ্রেণীকে ‘সান্ত্বনার মলম' দেয়ার জন্য এবং তাদেরকে প্রতারিত করার উদ্দেশ্যে বিপ্লবীদের নামের সাথে একটা জৌলুস জুড়ে দেয়া হয়; সেই-সঙ্গে তাদের বৈপ্লবিক মতবাদের মর্মবস্তুকে ছেটে দিয়ে সেটিকে নপুংসক করে রাখা হয়, তাদের বৈপ্লবিক তীক্ষ্মতা ভোঁতা করে দেওয়া হয়। বর্তমান সময়ে বুর্জোয়া শ্রেণী এবং শ্রমজীবী শ্রেণীর আন্দোলনের মধ্যে লুকিয়ে থাকা সুবিধাবাদীরা মার্ক্সবাদ ‘সংশোধনে’র কাজে পরস্পরের সাথে হাতে হাত মিলিয়ে চলছে। তারা মার্কসীয় তত্ত্বের বৈপ্লবিক মর্মকেই পরিহার করে, মুছে ফেলে এবং বিকৃত করে।"
আসুন, মার্ক্সের আসল বিপ্লবী স্বত্তাকে আবার প্রতিষ্ঠা করা যাক!