গত ১০ই জুলাই রাষ্ট্রপতির সনদ স্বাক্ষরের মাধ্যমে, ৫৩৪ খ্রিস্টাব্দে স্থাপিত একটি ঐতিহাসিক বাইজেন্টাইন চার্চ আয়া সোফিয়াকে জাদুঘর থেকে মসজিদে রূপান্তরের সিদ্ধান্ত নেয় এরদোয়ান সরকার। তুরস্কে আধুনিক বুর্জোয়া রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা কামাল আতাতুর্ক ১৯৩৪ সালে বাইজেন্টাইনের এই ঐতিহাসিক নিদর্শনটিকে জাদুঘরে রূপান্তর করে, এই রূপান্তরকরণ তুর্কি রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতীক হিসেবেও কাজ করেছিল তৎকালীন সময়ে। বর্তমানে পুনরায় এরদোয়ানের এই রূপান্তরকরণকেও একটি প্রতীকী আচরণ হিসেবে ব্যাখ্যা করা যায়, নব্য-অটোমান সাম্রাজ্যবাদী “সুলতান” এরদোয়ান এবং প্রতিক্রিয়াশীল তুর্কি বুর্জোয়া শ্রেণীর আধিপত্যের প্রতীক।
এটা কোনও দৈব ঘটনা নয় যে এই রূপান্তরকরণের মূল উদ্বোধনী তারিখ ২৪শে জুলাই, এই একই তারিখে ল্যসাঁ চুক্তিও (Treaty of Lausanne) স্বাক্ষরিত হয়েছিল। যে চুক্তি মূলত বর্তমান তুর্কি রাষ্ট্রের সীমান্ত নির্ধারণ করে দিয়েছিল এবং যে সীমান্ত বর্তমান এরদোয়ান সরকার সংস্কার করতে চায়।
এই পদক্ষেপ এবং তার সাথে অন্যান্য কার্যাবলীর মাধ্যমে তুর্কি বুর্জোয়া শ্রেণী এই সংকেতই দিতে চাচ্ছে যে, তারা উক্ত অঞ্চলে একটি পরাশক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে চায় এবং দক্ষিনপূর্ব ভূমধ্য অঞ্চলে যে তেল ও গ্যাস শোষণ করে নেয়া হচ্ছে সেই শোষণে তারাও ভাগ বসাতে চায়, সেখান থেকে তাদেরকে সরিয়ে দেয়ার ব্যাপারটি তারা মেনে নিবেনা। এছাড়াও পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্যের কুর্দিশদের বৈশ্বিক সমর্থন সহ আরও অন্যান্য পদক্ষেপগুলোকে তারা নিজেদের জন্য হুমকিস্বরূপ মনে করছে।
এরদোয়ান সরকার অবশ্য শুধুমাত্র প্রতীকী কার্যকলাপেই সীমাবদ্ধ নেই। বিশেষ করে সাম্প্রতিক সময়ে কয়েক মাস ধরে তুর্কি রাষ্ট্র তীব্রভাবেই তার সামরিক তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে লিবিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যে। এছাড়া লিবিয়াতে আধুনিক সমরাস্ত্র এবং জিহাদী যোদ্ধাদের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের প্রতিক্রিয়াস্বরূপ মনে হচ্ছে তারা আপাতত ক্ষমতার দাঁড়িপাল্লাকে কিছুটা ত্রিপোলি সরকারের(Government of National Accord) দিকেই ঝুকিয়ে দিতে চাচ্ছে এবং রাশিয়া, মিশর ও ফ্রান্সসহ অন্যান্য রাষ্ট্র দ্বারা সমর্থিত জেনারেল হাফতারের বিরুদ্ধে পায়তারা করছে। এমনকি এরদোয়ান ফ্রান্সের সাথেও সম্পর্কের অবনতি ঘটিয়েছে সাম্প্রতিক সময়ে, যখন ফ্রান্সের যুদ্ধজাহাজ একটি তুর্কি যাত্রীবাহী জাহাজের উপর দখল নিতে চেয়েছিলো, কারন তারা সন্দেহ করছিলো উক্ত জাহাজে করে লিবিয়াতে অস্ত্রপাচার হচ্ছিল। এছাড়াও গত ১৭ই জুন তুর্কি সেনাবাহিনী উত্তর ইরাকে সামরিক তৎপরতা চালায় PKK(কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টি) এর বিরুদ্ধে, যে অঞ্চলটি মূলত আধা-স্বায়ত্বশাসিত কুর্দিশ অঞ্চল বলে পরিচিত।
কপর্দকহীন এরদোয়ান
তবে যাইহোক, “সুলতান” এরদোয়ানের এসব সাম্রাজ্যবাদী উচ্চাকাঙ্ক্ষা আদতে তার নিজস্ব কপর্দকহীনতা ঢাকতে সাহায্য করছেনা মোটেও। বর্তমানে তুরস্কের অর্থনৈতিক অবস্থা উক্ত অঞ্চলে ক্ষমতা প্রদর্শনের নগ্ন খেলার জন্য মোটেও উপযুক্ত নয়। সাম্প্রতিক সময়ে এটি আরও সত্য কারন অতীত ইতিহাসের সাথে তুলনা করলে বর্তমানের মত বৈশ্বিকভাবে পুঁজিবাদের এমন বৃহত্তর সংকটের মুখোমুখি তুর্কী অর্থনীতি আগে কখনও হয়নি। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের(IMF) এর হিসাব অনুযায়ী ২০২০সাল নাগাদ তুরস্কের জিডিপি ৫ শতাংশ পতনের মুখোমুখি হতে পারে, বেকারত্বও বেড়ে ১৭.২ শতাংশে পৌঁছাবে এবং পাশাপাশি মুদ্রাস্ফীতির সংকটও ১২ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে, এছাড়াও তুর্কি পাউন্ডের মূল্যও পতনের সম্মুখীন হবে।
সংকটের এই গভীরতা এবং তুর্কি জনগণের ভোগান্তি দিনকে দিন আরও বৃদ্ধি পাবে, যার ফলে তা অবধারিতভাবেই শ্রেণী সংগ্রামের চেহারায় রূপ নিবে, তার সাথে ইতোমধ্যেই বিভক্ত হওয়া বুর্জোয়াদের মধ্যকার ফাঁটলও প্রশস্ত হবে। আগ্রাসী পররাষ্ট্র নীতির মাধ্যমে এরদোয়ান সরকার যে স্বার্থই হাসিল করতে চাচ্ছেনা কেন, তা মূলত জাতীয়তাবাদ এবং ধর্মীয় উন্মাদনার আগুনে ঘি ঢেলে নিজস্ব রাষ্ট্রীয় সংকট থেকে জনগণের মনযোগের কেন্দ্রবিন্দু সরানোর উদ্যোগ কেবল। আয়া সোফিয়াকে মসজিদে রূপান্তকরণের পদক্ষেপটি মূলত এসবই প্রমাণ করে কারন সাম্প্রতিক সময়ে কয়েকবছর ধরেই এই দাবীটি তুর্কি প্রতিক্রিয়াশীল বুর্জোয়াদের দাবী।
সন্দেহাতীতভাবেই এই পদক্ষেপটি কিছু সময়ের জন্য এরদোয়ান সরকারের শরীরকে চাঙ্গা করবে, যার প্রতিফলন বিভিন্ন জনমত পোলের মধ্যেও দেখা যেতে পারে, কিন্তু এটি কোনওভাবেই বর্তমান সময়ে তার সরকারের বিরুদ্ধে যে গণবিদ্বেষের তৈরী হয়েছে তা ঠেকাতে পারবেনা। এরদোয়ানের দল(AKP) সাম্প্রতিক কিছু বছরে নির্বাচনী সমর্থন হারিয়েছে বৃহৎ অংশের, এর প্রতিফলন আমরা মিউনিসিপাল এবং প্রাদেশিক নির্বাচনের ফলাফলে দেখতে পাই, যার ফলে ইস্তানবুল সহ আরও কিছু বৃহৎ শহরের উপর থেকে এরদোয়ান পার্টির দখল হাতছাড়া হয়েছে।
বৈশ্বিক ঐতিহ্যবাহী এই স্থানটিকে জাতীয়তাবাদ এবং ধর্মীয় উন্মাদনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করার পায়তারার বিরুদ্ধে অবশ্যই স্বোচ্চার থাকবে আন্তর্জাতিক শ্রমিক আন্দোলন। তুর্কি কম্যুনিস্ট পার্টি এই ব্যাপারে তাদের অবস্থান যথাযথভাবেই পরিষ্কার করে দিয়েছে স্পষ্ট বিবৃতির মাধ্যমেঃ “আয়া সোফিয়াকে জনসাধারনের জাদুঘর হিসেবে বলবৎ রাখার ব্যাপারটিকে তুর্কি কম্যুনিস্ট পার্টি সবসময়েই সমর্থন করে এসেছে, কারন এটি মানবসভ্যতার একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক নিদর্শন এবং ঐতিহাসিক নিদর্শনের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত”, এছাড়াও তারা এরদোয়ান সরকার এবং তুর্কি বুর্জোয়াদের এই প্রতিক্রিয়াশীল সিদ্ধান্তের একেবারে বিরুদ্ধেই অবস্থান নিয়েছে। তুরস্কের বামপন্থী দল পিপল’স ওয়ার্কার্স পার্টি(HDP) এর বিবৃতিও অনুরূপঃ “আয়া সোফিয়া মানবসভ্যতার একটি গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক এবং ঐতিহাসিক নিদর্শন। এটিকে মসজিদের রুপান্তর করা হবে একটি গর্হিত কাজ… রাষ্ট্রীয় কাউন্সিল এই সিদ্ধান্তে একমত পোষণ করে এটাই প্রমান করছে যে তারাও এরদোয়ানের দল AKP এর একটি প্রপাগান্ডা যন্ত্রের অংশে পরিণত হয়েছে। এই সিদ্ধান্ত এখনই প্রত্যাহার করা উচিত।”
গ্রিক কম্যুনিস্ট এবং শাসকশ্রেণীর পদক্ষেপ
গ্রিসের কম্যুনিস্ট পার্টিকে অবশ্যই এটা স্বীকার করতে হবে যে বাইজেন্টাইনের এই নিদর্শনকে জাদুঘর হিসেবেই রাখা উচিত এবং এরদোয়ানের প্রতিক্রিয়াশীল সিদ্ধান্তের বিরোধীতা করতে হবে। তবে আরও একটি দায়ীত্ব রয়েছে গ্রিসের কম্যুনিস্ট পার্টির, সেটি হচ্ছে সবার আগে তার নিজের দেশের বুর্জোয়া প্রতিক্রিয়াশীলদের মুখোশ উন্মোচন করতে হবে।
এরদোয়ানের এই সিদ্ধান্ত মূলত গ্রিক বুর্জোয়াদের জন্য একটি মূল্যবান উপহারসামগ্রীর মত, তারা আয়া সোফিয়ার এই ইস্যুটিকে কেন্দ্র করে নিজেদের রাষ্ট্রেও জাতীয়তাবাদের উন্মাদনা ছড়াতে সক্ষম হবে। যেমনটা তারা মেসিডোনিয়ান প্রশ্ন ইস্যুটির সময়ে করেছিলো এবং এভ্রোসের শরণার্থীদের “অনুপ্রবেশকারী” আখ্যা নিয়ে নিপীড়ন চালিয়েছিল, যাতে করে তার নিজস্ব প্রতিক্রিয়াশীল পলিসি সমূহের সংকট থেকে জনগনের মনোযোগ সরাতে সক্ষম হয়।
কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে কম্যুনিস্ট পার্টি অফ গ্রিস(KKE) এর নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গরা তুর্কি শাসকশ্রেণীর “আগ্রাসন” এবং “উত্তেজনা ছড়ানোর প্ররোচনা” এই দুইটি বিষয়ের উপর বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকে, যার ফলে অন্যদিকে গ্রিক বুর্জোয়াদের প্রতিক্রিয়াশীল ভূমিকার ব্যাপারটি ধামা চাপা পড়ে যায়। গ্রিক কম্যুনিস্ট পার্টি পুঁজিবাদী গ্রিসের সার্বভৌম অধিকারগুলোকে রক্ষা করতে স্বোচ্চার, যার প্রতিফলন আমরা উক্ত পার্টির সাধারন সম্পাদক ডি. কৌতসোবাসের বিবৃতিতে দেখতে পাইঃ “আয়া সোফিয়ার মত একট বৈশ্বিক ঐতিহ্যবাহী নিদর্শনকে মসজিদে রূপান্তর করার যে সিদ্ধান্ত এরদোয়ান সরকার নিয়েছে তা একেবারেই অগ্রহনযোগ্য এবং উত্তেজনা সৃষ্টিকারী, এর ফলে এটাই প্রমাণিত হয় যে ধীরে ধীরে তুরস্কের এই উত্তেজনা প্ররোচনাকারী পদক্ষেপ আরও বিস্তার লাভ করবে”।
কিন্তু যেমনটি আমরা আমাদের আগের প্রবন্ধসমূহে ব্যাখ্যা করেছিলাম, গ্রিক শাসকশ্রেণীও একইরকম প্রতিক্রিয়াশীল এবং প্ররোচনাকারী, যার প্রমাণ আমরা দেখতে পাই ইসরাইল, মিশর এবং সাইপ্রাস যে উদ্যোগ নিয়েছিলো তুরস্ককে ভূমধ্য অঞ্চলের হাইড্রোকার্বনসমূহ শোষণ করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করার, সেটিকে গ্রিসের শাসকশ্রেণী সমর্থন দিয়েছিলো উক্ত রাষ্ট্রসমূহের সাথে আঁতাত করার মাধ্যমে।
পরবর্তী পর্যায়ে এই প্রতিযোগী বুর্জোয়া শক্তিগুলো তীব্রভাবে জাতীয়তাবাদ এবং যুদ্ধভীতি ছড়ানোর মাধ্যমে তাদের নিজস্ব অঞ্চলে শ্রেণী সংগ্রাম গড়ে ওঠার সম্ভাবনা দমানোর চেষ্টায় লিপ্ত হবে। উভয় অঞ্চলের কম্যুনিস্ট আন্দোলনকারীদেরকেই এই বুর্জোয়া ধোঁকাবাজি নাকচ করে দিতে হবে এবং যে করেই হোক একটি নিখাদ প্রলেতেরিয়ান আন্তর্জাতিকতাবাদের পলিসিকে সমর্থন করতে হবে। এসব পলিসির মধ্যে রয়েছে, দক্ষিনপূর্ব ভূমধ্য অঞ্চলের শ্রমিকদেরকে একসাথে সংঘবদ্ধ করে মিলিটান্ট একশনে যাওয়া, উক্ত অঞ্চলের সকল সাম্রাজ্যবাদী বিবাদ, জাতীয়তাবাদী ঘৃনা দমন করা, যার মূল লক্ষ্য হবে গ্রিস, তুরস্ক, সাইপ্রাস এবং পুরো দক্ষিনপূর্ব ভূমধ্য অঞ্চলেই সমাজতন্ত্র কায়েম করা। উক্ত অঞ্চলে স্থায়ী শান্তি এবং প্রগতি কায়েম করার এটাই একমাত্র পথ!